মক্কা ও মদিনাবাসী শুরু থেকেই ইয়াজিদের প্রতি অনুগত ছিল না। বিভিন্ন চাপে পড়ে তারা আনুগত্যের বাইয়াত গ্রহণ করে। কিন্তু যখন হুসাইন রা.-কে ইয়াজিদের বাহিনী খুন করে তখন মদিনাবাসী ক্ষিপ্ত হয় এবং ইয়াজিদের প্রতি বাইয়াত প্রত্যাহার করে। তারা আব্দুল্লাহ ইবন হানযালাকে নেতা নির্বাচন করল। তারা সকলে মসজিদে নববীর মিম্বরের কাছে জমায়েত হল।
তখন তাদের মধ্যে হতে একজন বলতে লাগলেন, আমি এ পাগড়ীকে প্রত্যাহার করলাম এ বলে সে মাথা থেকে পাগড়ীটি ফেলে দিল। অন্য একজন বলল, আমি ইয়াযীদকে প্রত্যাহার করলাম যেমন আমি আমার এ জুতা প্রত্যাহার করলাম,। এ বলে সে তার জুতা ছুঁড়ে মারলো। এভাবে একজনের পর একজন বলতে লাগল ও এরূপ করতে লাগল। ফলে সেখানে অনেক পাগড়ী ও জুতার স্তুপ হয়ে গেল। তারপর তারা তাদের মধ্যে থেকে ইয়াজিদের গভর্নরকে বহিষ্কার করার ব্যাপারে একমত হল। তিনি হলেন উসমান ইবন মুহাম্মদ ইবন আবু সুফিয়ান, ইয়াযীদের চাচাতো ভাই। বনূ উমাইয়ার সদস্যদেরকে মদীনা থেকে বিতাড়িত করার ব্যাপারেও তারা একমত হলো।
অবস্থা বেগতিক দেখে বনু উমাইয়ার লোকেরা মারওয়ান ইবন হাকাম-এর ঘরে একত্রিত হলো। আর মদীনাবাসীরা তাদেরকে চতুর্দিক দিয়ে ঘিরে রাখল। কিন্তু কিশোর আলী ইবনুল হুসাইন ওরফে জয়নুল আবেদীন এবং নবী পরিবারের নারী সদস্যরা এই আয়োজনের সাথে ছিলেন না। তারা নিজ ঘরে নিশ্চুপ ছিলেন।
মদিনার লোকদের আনুগত্য অস্বীকারের খবর ও বনু উমাইয়ার সদস্যদের অবরুদ্ধ হওয়ার খবর ইয়াজিদের কাছে পৌঁছলো। তিনি মুসলিম ইবনে উকবাকে সেনাপতি বানিয়ে বললেন, “মদিনার সম্প্রদায়কে তুমি তিনবার আহবান করবে, যদি তারা বশ্যতা স্বীকার করে তাহলে তুমি তাদের থেকে আনুগত্য গ্রহণ করবে এবং তাদের থেকে বিরত থাকবে, অন্যথায় তুমি আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করবে এবং তাদের সাথে যুদ্ধ করবে। যদি তুমি তাদের উপর বিজয় লাভ করো তবে মদিনায় তিনদিন হালাল ঘোষণা করবে (যা ইচ্ছা তা করবে, হারাম কাজও হালাল বলে গণ্য হবে)। তারপর বিরত হবে। আলী ইবন হুসাইনের প্রতি নযর রাখবে, তার থেকে বিরত থাকবে এবং তার কল্যাণ কামনা করবে, তাকে মজলিসে ডেকে নিবে। মদীনার কাজ সমাপ্ত করে মক্কা অবরোধ করবে।
ইতপূর্বে ইয়াজিদ উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদকে আদেশ দিয়েছিলেন, সে যেন আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর রা.-কে মক্কায় অবরোধ করার জন্য সেখানে গমন করে। কিন্তু উবাইদুল্লাহ ইবন যিয়াদ তার আদেশ অমান্য করে এবং বলে আল্লাহর শপথ! আমি ইয়াজিদের ন্যয় এরূপ ফাসিক লোকের জন্য দুইটি মারাত্মক কাজ একত্রে করতে পারবো না। একটি হল রাসূল সা. এর নাতিকে হত্যা করা এবং দ্বিতীয়টি হল মহাসম্মনিত বাইতুল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। তার মা মারজানা তাকে ইমাম হুসাইন রা.-এর শাহাদাতের সময় বলেছিলেন, দুর্ভাগ্য তোর! অভিশপ্ত তুই! তুই কী করেছিস! তুই কীসের দায়িত্ব নিয়েছিস? হুসাইন রা.-এর শাহদাতের পর তার আত্মীয়রা তাকে তিরস্কার করলে সে কিছুটা হীনমন্যতায় পড়ে যায়।
মুসলিম ইবনে উকবা তার সেনাবাহিনী নিয়ে মদীনার দিকে রওয়ানা হলো, সেনাবাহিনী যখন মদীনার নিকটবর্তী হলো, মদীনাবাসীরা বনু উমাইয়ার সদস্যদের অবরোধে কঠোরতা অবলম্বন করতে লাগল এবং বলতে লাগল, আল্লাহর শপথ! আমরা তোমাদের সকলকে এখনই হত্যা করবো। যদি তোমরা আমাদেরকে এমন একটি চুক্তিনামা লিখে দাও যে, তোমরা সিরিয়ার সৈন্যদেরকে আমাদেরকে চিনিয়ে দেবে না, আমাদের সাথে যুদ্ধে তাদের সহায়তা করবে না এবং আমাদের প্রতি তাদেরকে উসকানিও দিবে না। তখন বনূ উমাইয়ার লোকেরা তাদেরকে এ ব্যাপারে একটি অঙ্গীকারনামা প্রদান করলো।
যখন ইয়াজিদ বাহিনী মদিনায় পৌঁছল তখন বন্ উমাইয়ার লোকেরা তাদের সাথে সাক্ষাত করলো। সেনাপতি তাদের খবরাখবর সম্বন্ধে জিজ্ঞাস করলো, তখন তাদের কেউ তাকে কোন সংবাদ দিল না। আবদুল মালিক ইবন মারওয়ান সেনাপতির কাছে আসলো এবং বললো, যদি আপনি তাদের উপর জয়ী হতে চান তাহলে আপনি মদিনার পূর্বদিকে হাররায় সেনাবাহিনী নিয়ে অবস্থান নিন। যখন শত্রুরা আপনার দিকে আসবে তখন সূর্যের তাপ থাকবে তাদের চোখে মুখে। এমন সময় আপনি তাদেরকে আপনার বাধ্যতা স্বীকার করতে আহবান জানাবেন। যদি তারা আপনার আহবানে সাড়া দেয় তাহলে ভাল কথা, অন্যথায় তাদেরকে হত্যা শুরু করবেন। আল্লাহ তাআলা আপনাকে তাদের বিরুদ্ধে সাহায্য করবেন। কেননা তারা দেশের ইমাম তথা খলীফার বিরুদ্ধাচরণ করছে এবং তার অবাধ্য হয়েছে।
এ পরামর্শ দেওয়ার জন্য মুসলিম ইবন উকবা আবদুল মালিক ইবন মারওয়ানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং তিনি যেদিকে ইঙ্গিত করলেন তা তিনি পরোপুরি পালন করলেন। তিনি পূর্ব মদীনার হাররায় অবতরণ করেন এবং মদীনাবাসীদেরকে তিনদিনের অবকাশ দিলেন। মদিনাবাসী তাদেরকে অন্যায়ের পথ ছেড়ে ন্যায়ের পথে আসার আহবান জানালেন। তারা অবৈধ শাসকের আনুগত্যের বিপরীতে শাহদাতকে আপন করে নেয়ার শপথ নিলেন। প্রতিদিন তারা বশ্যতা স্বীকার না করে যুদ্ধ ও মুকাবিলার কথা পুনরাবৃত্তি করলেন।
যখন তিনদিন শেষ হয়ে গেল তখন সেনাপতি তাদরকে চতুর্থ দিন অর্থাৎ ৬৩ হিজরীর জুলহাজ্জ মাসের ২৮ তারিখ বুধবার দিন বললো, হে মদীনাবাসীগণ! তিনদিন অতিবাহিত হলো, আমীরুল মু'মিনীন আমাকে বলেছিলেন যে, তোমরা তার আত্মীয়স্বজন। তাই তিনি তোমাদের রক্তপাতকে খারাপ মনে করেন। তিনি আমাকে হুকুম দিয়েছেন আমি যেন তোমাদেরকে তিন দিনের সময় দেই। তিনদিন শেষ হয়ে গেল। এখন তোমরা কি করবে? তোমরা কি আমাদের সাথে যুদ্ধ করবে, না সন্ধি করবে? তারা বললেন, যুদ্ধ করবো।
মুসলিম আবার বললো, যুদ্ধ করো না বরং সন্ধি করো তাহলে আমরা ঐ বিদ্রোহী ব্যক্তিকে (আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর রা.) দমন করার জন্য সর্বশক্তি ও প্রচেষ্টা প্রয়োগ করতে পারব। তারা বললেন, “হে আল্লাহর দুশমন! তোমার যদি এটাই ইচ্ছে হয়ে থাকে তাহলে আমরা কখনোই তোমার সহযোগী হবো না। আমরা কি তোমাদেরকে ছেড়ে দিব যে, তোমরা বাইতুল্লাহ গিয়ে যথেচ্ছা আচরণ করবে? তারপর তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিল।
মদিনাবাসী বিশাল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পরিখা খনন করে নিলেন। তারা নিজেদের সৈন্যদেরকে চার ভাগে ভাগ করে নেয় এবং প্রতিটি ভাগের জন্য একজন আমীর নিয়োগ করে। সবচাইতে সুবিন্যস্থ ভাগের আমীর হলেন আবদুল্লাহ ইবন হানযালা। তারপর তারা প্রচণ্ড যুদ্ধ করলেন। যুদ্ধে মদীনাবাসীরা পরাজয়বরণ করলেন। দু'পক্ষ থেকেই বহু সর্দার ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ নিহত হলেন। এই ঘটনাকে ইতিহাসে 'আল হাররা'র যুদ্ধ' হিসেবে অভিহিত করা হয়।
তারপর এক জঘন্য ঘটনার অবতারণা হলো মদিনায়। মুসলিম ইবন উকবা তার নেতা ইয়াজিদের নির্দেশমতে মদিনায় তিন দিন যাবত লুটতরাজ করার নির্দেশ দিলো। সে এ তিন দিনে মদীনার বহু সাহাবি, সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ ও ন্যায়নিষ্ঠ লোকদের পাইকারিভাবে হত্যা করতে শুরু করলো। মদিনায় জঘন্যতম লুট, ধর্ষণ, নির্যাতন ও উৎপীড়নের অজস্র ঘটনা সংঘটিত হতে থাকে। মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে হতে সাতশত জন গণ্যমান্য ব্যক্তি, তাদের দাস-দাসী এবং অপরিচিত ব্যক্তিদের মধ্যে দশ হাজার নিহত হয়েছিল। বহু সম্মানিত মুসলিম নারী ধর্ষিত হয়েছেন ইয়াজিদের বাহিনীর দ্বারা।
জালিম ইয়াজিদ তিনদিনের জন্য মদিনাকে লুটপাটের লক্ষ্যে মুসলিম ইবন উকবাকে নির্দেশনা দিয়ে জঘন্য অপরাধ করেছে। যার দরুন সাহাবায়ে কিরামের একটি বিরাট দল ও তাদের সন্তানগণ নিহত হন। বহু সম্মানিত নারী ধর্ষিত হয়েছেন। সা'দ ইবন আবু ওয়াক্কাস রা. হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমি রাসূল (সা)-কে বলতে শুনেছি, “যদি কেউ মদীনাবাসীদের সাথে ষড়যন্ত্র করে তাহলে লবন যেভাবে পানিতে গলে নিঃশেষ হয়ে যায় সেও এভাবে গলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।” ইমাম মুসলিমও আবু আবদুল্লাহ সা'দ ইব্ন আবু ওয়াক্কাস রা. হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “যদি কোন ব্যক্তি মদীনাবাসীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে তাহলে আল্লাহ্ তা'আলা তাকে জাহান্নামে এমনভাবে গলাবেন যেমন সীসা আগুনে গলে যায় কিংবা লবণ যেভাবে পানিতে গলে যায়।”
কিছু অর্বাচীন ও জ্ঞানপাপীকে দেখা যায় নানানভাবে ইয়াজিদকে শাসক এমনকি আমিরুল মুমেনিন হিসেবে আখ্যায়িত করতে। যে পাইকারীভাবে খুন ও ধর্ষণ করার নির্দেশ দেয় সে মুসলিমদের নেতা হওয়া তো দূরের কথা তাকে মুসলিম হিসেবে বিবেচনা করাও তো কঠিন। তার আক্রমনের পর মদিনার সমস্ত সাহাবী হয় খুন হয় নাহয় জঙ্গলে পালিয়ে যায়। সাহাবাদের সাথে যার এই আচরণ সে জালিম ও ফাসিক, এটাই তার পরিচয়। আল্লাহ তায়ালা তার যথোপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করুন। আমিন।
বি. দ্র. ঘটনার বর্ণনা আল্লামা ইবনে কাসীরের বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ 'আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া'-এর ৮ম খন্ড (৪০০-৪১৫) থেকে নেওয়া হয়েছে।
তখন তাদের মধ্যে হতে একজন বলতে লাগলেন, আমি এ পাগড়ীকে প্রত্যাহার করলাম এ বলে সে মাথা থেকে পাগড়ীটি ফেলে দিল। অন্য একজন বলল, আমি ইয়াযীদকে প্রত্যাহার করলাম যেমন আমি আমার এ জুতা প্রত্যাহার করলাম,। এ বলে সে তার জুতা ছুঁড়ে মারলো। এভাবে একজনের পর একজন বলতে লাগল ও এরূপ করতে লাগল। ফলে সেখানে অনেক পাগড়ী ও জুতার স্তুপ হয়ে গেল। তারপর তারা তাদের মধ্যে থেকে ইয়াজিদের গভর্নরকে বহিষ্কার করার ব্যাপারে একমত হল। তিনি হলেন উসমান ইবন মুহাম্মদ ইবন আবু সুফিয়ান, ইয়াযীদের চাচাতো ভাই। বনূ উমাইয়ার সদস্যদেরকে মদীনা থেকে বিতাড়িত করার ব্যাপারেও তারা একমত হলো।
অবস্থা বেগতিক দেখে বনু উমাইয়ার লোকেরা মারওয়ান ইবন হাকাম-এর ঘরে একত্রিত হলো। আর মদীনাবাসীরা তাদেরকে চতুর্দিক দিয়ে ঘিরে রাখল। কিন্তু কিশোর আলী ইবনুল হুসাইন ওরফে জয়নুল আবেদীন এবং নবী পরিবারের নারী সদস্যরা এই আয়োজনের সাথে ছিলেন না। তারা নিজ ঘরে নিশ্চুপ ছিলেন।
মদিনার লোকদের আনুগত্য অস্বীকারের খবর ও বনু উমাইয়ার সদস্যদের অবরুদ্ধ হওয়ার খবর ইয়াজিদের কাছে পৌঁছলো। তিনি মুসলিম ইবনে উকবাকে সেনাপতি বানিয়ে বললেন, “মদিনার সম্প্রদায়কে তুমি তিনবার আহবান করবে, যদি তারা বশ্যতা স্বীকার করে তাহলে তুমি তাদের থেকে আনুগত্য গ্রহণ করবে এবং তাদের থেকে বিরত থাকবে, অন্যথায় তুমি আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করবে এবং তাদের সাথে যুদ্ধ করবে। যদি তুমি তাদের উপর বিজয় লাভ করো তবে মদিনায় তিনদিন হালাল ঘোষণা করবে (যা ইচ্ছা তা করবে, হারাম কাজও হালাল বলে গণ্য হবে)। তারপর বিরত হবে। আলী ইবন হুসাইনের প্রতি নযর রাখবে, তার থেকে বিরত থাকবে এবং তার কল্যাণ কামনা করবে, তাকে মজলিসে ডেকে নিবে। মদীনার কাজ সমাপ্ত করে মক্কা অবরোধ করবে।
ইতপূর্বে ইয়াজিদ উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদকে আদেশ দিয়েছিলেন, সে যেন আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর রা.-কে মক্কায় অবরোধ করার জন্য সেখানে গমন করে। কিন্তু উবাইদুল্লাহ ইবন যিয়াদ তার আদেশ অমান্য করে এবং বলে আল্লাহর শপথ! আমি ইয়াজিদের ন্যয় এরূপ ফাসিক লোকের জন্য দুইটি মারাত্মক কাজ একত্রে করতে পারবো না। একটি হল রাসূল সা. এর নাতিকে হত্যা করা এবং দ্বিতীয়টি হল মহাসম্মনিত বাইতুল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। তার মা মারজানা তাকে ইমাম হুসাইন রা.-এর শাহাদাতের সময় বলেছিলেন, দুর্ভাগ্য তোর! অভিশপ্ত তুই! তুই কী করেছিস! তুই কীসের দায়িত্ব নিয়েছিস? হুসাইন রা.-এর শাহদাতের পর তার আত্মীয়রা তাকে তিরস্কার করলে সে কিছুটা হীনমন্যতায় পড়ে যায়।
মুসলিম ইবনে উকবা তার সেনাবাহিনী নিয়ে মদীনার দিকে রওয়ানা হলো, সেনাবাহিনী যখন মদীনার নিকটবর্তী হলো, মদীনাবাসীরা বনু উমাইয়ার সদস্যদের অবরোধে কঠোরতা অবলম্বন করতে লাগল এবং বলতে লাগল, আল্লাহর শপথ! আমরা তোমাদের সকলকে এখনই হত্যা করবো। যদি তোমরা আমাদেরকে এমন একটি চুক্তিনামা লিখে দাও যে, তোমরা সিরিয়ার সৈন্যদেরকে আমাদেরকে চিনিয়ে দেবে না, আমাদের সাথে যুদ্ধে তাদের সহায়তা করবে না এবং আমাদের প্রতি তাদেরকে উসকানিও দিবে না। তখন বনূ উমাইয়ার লোকেরা তাদেরকে এ ব্যাপারে একটি অঙ্গীকারনামা প্রদান করলো।
যখন ইয়াজিদ বাহিনী মদিনায় পৌঁছল তখন বন্ উমাইয়ার লোকেরা তাদের সাথে সাক্ষাত করলো। সেনাপতি তাদের খবরাখবর সম্বন্ধে জিজ্ঞাস করলো, তখন তাদের কেউ তাকে কোন সংবাদ দিল না। আবদুল মালিক ইবন মারওয়ান সেনাপতির কাছে আসলো এবং বললো, যদি আপনি তাদের উপর জয়ী হতে চান তাহলে আপনি মদিনার পূর্বদিকে হাররায় সেনাবাহিনী নিয়ে অবস্থান নিন। যখন শত্রুরা আপনার দিকে আসবে তখন সূর্যের তাপ থাকবে তাদের চোখে মুখে। এমন সময় আপনি তাদেরকে আপনার বাধ্যতা স্বীকার করতে আহবান জানাবেন। যদি তারা আপনার আহবানে সাড়া দেয় তাহলে ভাল কথা, অন্যথায় তাদেরকে হত্যা শুরু করবেন। আল্লাহ তাআলা আপনাকে তাদের বিরুদ্ধে সাহায্য করবেন। কেননা তারা দেশের ইমাম তথা খলীফার বিরুদ্ধাচরণ করছে এবং তার অবাধ্য হয়েছে।
এ পরামর্শ দেওয়ার জন্য মুসলিম ইবন উকবা আবদুল মালিক ইবন মারওয়ানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং তিনি যেদিকে ইঙ্গিত করলেন তা তিনি পরোপুরি পালন করলেন। তিনি পূর্ব মদীনার হাররায় অবতরণ করেন এবং মদীনাবাসীদেরকে তিনদিনের অবকাশ দিলেন। মদিনাবাসী তাদেরকে অন্যায়ের পথ ছেড়ে ন্যায়ের পথে আসার আহবান জানালেন। তারা অবৈধ শাসকের আনুগত্যের বিপরীতে শাহদাতকে আপন করে নেয়ার শপথ নিলেন। প্রতিদিন তারা বশ্যতা স্বীকার না করে যুদ্ধ ও মুকাবিলার কথা পুনরাবৃত্তি করলেন।
যখন তিনদিন শেষ হয়ে গেল তখন সেনাপতি তাদরকে চতুর্থ দিন অর্থাৎ ৬৩ হিজরীর জুলহাজ্জ মাসের ২৮ তারিখ বুধবার দিন বললো, হে মদীনাবাসীগণ! তিনদিন অতিবাহিত হলো, আমীরুল মু'মিনীন আমাকে বলেছিলেন যে, তোমরা তার আত্মীয়স্বজন। তাই তিনি তোমাদের রক্তপাতকে খারাপ মনে করেন। তিনি আমাকে হুকুম দিয়েছেন আমি যেন তোমাদেরকে তিন দিনের সময় দেই। তিনদিন শেষ হয়ে গেল। এখন তোমরা কি করবে? তোমরা কি আমাদের সাথে যুদ্ধ করবে, না সন্ধি করবে? তারা বললেন, যুদ্ধ করবো।
মুসলিম আবার বললো, যুদ্ধ করো না বরং সন্ধি করো তাহলে আমরা ঐ বিদ্রোহী ব্যক্তিকে (আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর রা.) দমন করার জন্য সর্বশক্তি ও প্রচেষ্টা প্রয়োগ করতে পারব। তারা বললেন, “হে আল্লাহর দুশমন! তোমার যদি এটাই ইচ্ছে হয়ে থাকে তাহলে আমরা কখনোই তোমার সহযোগী হবো না। আমরা কি তোমাদেরকে ছেড়ে দিব যে, তোমরা বাইতুল্লাহ গিয়ে যথেচ্ছা আচরণ করবে? তারপর তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিল।
মদিনাবাসী বিশাল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পরিখা খনন করে নিলেন। তারা নিজেদের সৈন্যদেরকে চার ভাগে ভাগ করে নেয় এবং প্রতিটি ভাগের জন্য একজন আমীর নিয়োগ করে। সবচাইতে সুবিন্যস্থ ভাগের আমীর হলেন আবদুল্লাহ ইবন হানযালা। তারপর তারা প্রচণ্ড যুদ্ধ করলেন। যুদ্ধে মদীনাবাসীরা পরাজয়বরণ করলেন। দু'পক্ষ থেকেই বহু সর্দার ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ নিহত হলেন। এই ঘটনাকে ইতিহাসে 'আল হাররা'র যুদ্ধ' হিসেবে অভিহিত করা হয়।
তারপর এক জঘন্য ঘটনার অবতারণা হলো মদিনায়। মুসলিম ইবন উকবা তার নেতা ইয়াজিদের নির্দেশমতে মদিনায় তিন দিন যাবত লুটতরাজ করার নির্দেশ দিলো। সে এ তিন দিনে মদীনার বহু সাহাবি, সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ ও ন্যায়নিষ্ঠ লোকদের পাইকারিভাবে হত্যা করতে শুরু করলো। মদিনায় জঘন্যতম লুট, ধর্ষণ, নির্যাতন ও উৎপীড়নের অজস্র ঘটনা সংঘটিত হতে থাকে। মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে হতে সাতশত জন গণ্যমান্য ব্যক্তি, তাদের দাস-দাসী এবং অপরিচিত ব্যক্তিদের মধ্যে দশ হাজার নিহত হয়েছিল। বহু সম্মানিত মুসলিম নারী ধর্ষিত হয়েছেন ইয়াজিদের বাহিনীর দ্বারা।
জালিম ইয়াজিদ তিনদিনের জন্য মদিনাকে লুটপাটের লক্ষ্যে মুসলিম ইবন উকবাকে নির্দেশনা দিয়ে জঘন্য অপরাধ করেছে। যার দরুন সাহাবায়ে কিরামের একটি বিরাট দল ও তাদের সন্তানগণ নিহত হন। বহু সম্মানিত নারী ধর্ষিত হয়েছেন। সা'দ ইবন আবু ওয়াক্কাস রা. হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমি রাসূল (সা)-কে বলতে শুনেছি, “যদি কেউ মদীনাবাসীদের সাথে ষড়যন্ত্র করে তাহলে লবন যেভাবে পানিতে গলে নিঃশেষ হয়ে যায় সেও এভাবে গলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।” ইমাম মুসলিমও আবু আবদুল্লাহ সা'দ ইব্ন আবু ওয়াক্কাস রা. হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “যদি কোন ব্যক্তি মদীনাবাসীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে তাহলে আল্লাহ্ তা'আলা তাকে জাহান্নামে এমনভাবে গলাবেন যেমন সীসা আগুনে গলে যায় কিংবা লবণ যেভাবে পানিতে গলে যায়।”
কিছু অর্বাচীন ও জ্ঞানপাপীকে দেখা যায় নানানভাবে ইয়াজিদকে শাসক এমনকি আমিরুল মুমেনিন হিসেবে আখ্যায়িত করতে। যে পাইকারীভাবে খুন ও ধর্ষণ করার নির্দেশ দেয় সে মুসলিমদের নেতা হওয়া তো দূরের কথা তাকে মুসলিম হিসেবে বিবেচনা করাও তো কঠিন। তার আক্রমনের পর মদিনার সমস্ত সাহাবী হয় খুন হয় নাহয় জঙ্গলে পালিয়ে যায়। সাহাবাদের সাথে যার এই আচরণ সে জালিম ও ফাসিক, এটাই তার পরিচয়। আল্লাহ তায়ালা তার যথোপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করুন। আমিন।
বি. দ্র. ঘটনার বর্ণনা আল্লামা ইবনে কাসীরের বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ 'আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া'-এর ৮ম খন্ড (৪০০-৪১৫) থেকে নেওয়া হয়েছে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন