মুসলিম লীগ ১৯৪৭ সালে এই উপমহাদেশের মুসলিমদের জন্য পাকিস্তান রাষ্ট্র আদায় করে দিয়েছে ইংরেজদের কাছ থেকে। এই রাষ্ট্র মুসলিমদের নিরাপত্তায় ব্যাপক ভূমিকা রাখে। মুসলিমরা স্বতন্ত্র জাতির পরিচয় পায়। ১৯২৩ সালে তুর্কি খিলাফত বিলুপ্ত হলে মুসলিম পরিচয়ে আর কোনো রাষ্ট্র অবশিষ্ট থাকে নি। এর কয়েকবছর পর ৬/৭টি ভিন্ন ভাষাভাষি মানুষ শুধুমাত্র মুসলিম পরিচয়ে একত্রিত হয় ও উম্মাহ চেতনায় মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন করে।
কিন্তু মুসলিম লীগের এই বিশাল অর্জন ম্লান হতে থাকে কারণ তারা একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্র পরিচালনা করতে সক্ষম হয় নি। একটি সংবিধান বা শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে পারেনি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে, আন্দোলনের সময় তারা জাতিকে একটি ইসলামী রাষ্ট্রের কথা বলেছে। কিন্তু রাষ্ট্র গঠন হলে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার চেষ্টা করেছে। এছাড়াও নাস্তিক্যবাদের চিন্তার হামলা, কমিউনিজম চিন্তার হামলা পাকিস্তানের মুসলিমদের অশান্ত করে তুলেছিল। মুসলিম নেতারা তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিল।
এই ব্যর্থতার কথা অনুমান করে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী ১৯৪০ সাল থেকে সতর্ক করে আসছিলেন। যাই হোক তারপরও তিনি পাকিস্তানে চিন্তার ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য ও পাকিস্তানকে ব্যর্থতার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য একটি বক্তব্য দেন ষাটের দশকে। সেখানে জাতীয় ঐক্যের দিকে আহবান জানিয়েছেন সবাইকে। যেভাবে সবাই একত্র হয়েছিল পাকিস্তান আন্দোলনের সময়।
এই বক্তব্যটি বই আকারে প্রকাশ হয়। পাকিস্তানে বরাবরের মতো এই বইটি বেশ সমাদৃত হয়। বাংলাদেশে এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর তার স্বৈরাচারী আচরণ শুরু হয়। জনগণের নেতারা সঠিক নির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে ১৯৮৪ সালে আব্বাস আলী খান মাওলানা মওদূদীর এই বইটি বাংলায় অনুবাদ করেন। বাংলায় এর নামকরণ হয় জাতীয় ঐক্য ও গণতন্ত্রের ভিত্তি। ছোট বই, কিন্তু নির্দেশনা পরিষ্কার।
বইটির ভূমিকায় মাওলানা মানুষের প্রকৃতি তুলে ধরে বলেন, সব মানুষ সব বিষয়ে একমত হবে না। হওয়া জরুরীও নয়। তবে মৌলিক কিছু বিষয়ে তাকে একমত হতে হবে জাতির প্রয়োজনে, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে, শান্তির প্রয়োজনে, স্বাধীনতার প্রয়োজনে, ধ্বংস থেকে বাঁচার প্রয়োজনে। মাওলানা এরপর স্বাধীনতাত্তর পাকিস্তানের অবস্থা বর্ণনা করেন। এরপর তিনি ঐক্যের জন্য গঠনমূলক উপাদান খুঁজে বের করার আহবান জানান।
মাওলানা মওদূদী জাতীয় ঐক্যের জন্য পাঁচটি মূলনীতি নির্ধারণ করেন ও সেগুলো ব্যাখ্যা করেন। সেগুলো হলো,
১. সর্বাবস্থায় সততা ও সুবিচারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন।
২. পারস্পরিক সহনশীলতা এবং অন্যের মত প্রকাশের অধিকার মেনে নেওয়া।
৩. বিরোধীতার খাতিরে বিরোধীতা পরিহার করতে হবে।
৪. বলপ্রয়োগ ও প্রতারণার পরিবর্তে যুক্তি প্রদর্শন।
৫. ছোটখাটো ব্যাপারে বিদ্বেষ ও গোঁড়ামি পরিহার করা।
এরপর মাওলানা পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থার ভিত্তি/ মূলনীতি নিয়ে আলোচনা করেন। মূলনীতিগুলো হলো,
১. সর্বক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহর প্রাধান্য দেওয়া।
২. গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। মুসলিমদের মতামত দেবার ও শাসক বাছাইয়ের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
৩. গণতন্ত্রের প্রকৃত প্রাণশক্তি ও এর ৫ মূলনীতি
প্রথমত, রাষ্ট্রের তিনিটি বিভাগ শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইনসভাকে পৃথক করে দেওয়া। তাদের ক্ষমতার সীমারেখা সুষ্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা।
দ্বিতীয়ত, নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান এবং তা সংরক্ষণের জন্য বিচার বিভাগকে ক্ষমতা প্রদান।
তৃতীয়ত, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন ও নির্বাচনের ফলাফল যাতে মুসলিমদের জনমতের ভিত্তিতেই হয়।
চতুর্থত, আইনের শাসন। শাসক ও শাসিতের জন্য একই আইন হবে। সকলে আইন মানতে বাধ্য থাকবে। আদালত আইন সবার ওপর সমানভাবে প্রয়োগ করবে।
পঞ্চমত, সরকারি সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করবে না। তারা শাসনপদ্ধতি অনুযায়ী কাজ করবে। জনগণ যাদের শাসক মনোনীত করবে তাদের আনুগত্য করবে।
৪. নির্বাচন হতে হবে অবাধ ও সুষ্ঠু।
মাওলানা সবশেষে বলেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাফল্য ও স্থিতিশীলতা নির্ভর করবে সরকারের ওপর। যারা সরকার পরিচালনা করবে তারা যদি গণতন্ত্রের মূলনীতি ও শাসন ব্যবস্থার মূলনীতি মেনে চলে ও সংরক্ষণ করে তবে রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
#বুক_রিভিউ
বই : জাতীয় ঐক্য ও গণতন্ত্রের ভিত্তি
লেখক : সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী
অনুবাদক : আব্বাস আলী খান
প্রকাশনী : মওদূদী রিসার্চ একাডেমি, ঢাকা
পৃষ্ঠা : ২৬
মুদ্রিত মূল্য : ৯
জনরা : রাজনীতি
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন