উমার রা. তাঁর মৃত্যুর আগে নতুন খলিফার প্রতি একটি নসীহতমূলক বক্তব্য দিয়ে যান। যাতে করে নতুনভাবে নির্বাচিত খলিফার পক্ষে রাষ্ট্র পরিচালনা সহজ হয় ও তিনি একটি গাইড লাইন পান। এই বক্তব্য উপস্থিত সবাইকে নতুন খলিফার নিকট পৌঁছে দেয়ার অনুরোধ করেন। তিনি বলেন,
“আমি আপনাকে একমাত্র আল্লাহকে ভয় করার উপদেশ দিচ্ছি, যার কোনো শরিক নেই। প্রথমদিকের হিজরতকারীদের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ রাখবেন, তাদের অগ্রগামিতার কথা মনে রাখবেন। আনসারদের সাথে উত্তম আচরণের উপদেশ দিচ্ছি; তাদের মধ্যে যারা ভালো কাজ করবে তাদের প্রতি সমর্থন দেবেন, কেউ কোনো ভুল করলে ক্ষমা করে দেবেন।
সীমান্তবর্তী শহরগুলোর বাসিন্দাদের সাথে ভালো ব্যবহারের উপদেশ দিচ্ছি; কেননা তারাই শত্রুদের বিরুদ্ধে আমাদের ঢালস্বরূপ, সম্পদের উৎস। উদ্বৃত্ত অংশ ছাড়া তাদের সম্পদ থেকে কিছু নেবেন না। মরুভূমির লোকদের সাথে ভালো ব্যবহার করবেন, কেননা তারাই আরবের শেকড় এবং ইসলামের প্রাণ। তাদের অতিরিক্ত সম্পদ থেকে যা আদায় করবেন তা আবার তাদেরই গরিবদের মাঝে বণ্টন করে দেবেন।
অমুসলিম জিম্মি নাগরিকদের ব্যাপারে ওসিয়ত করছি, প্রয়োজনে যুদ্ধ করে হলেও যেন তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। তাদের ওপর আরোপিত জিযিয়া যদি তারা আদায় করে দেয়, অনুগত থাকে, তবে তাদের ওপর যেন সাধ্যাতীত বোঝা চাপানো না হয়।
ওসিয়ত করছি আল্লাহকে ভয় করার; তাঁর (হকের) ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন; তাহলে অন্যায় থেকে বিরত থাকতে পারবেন। মানুষের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করার এবং আল্লাহর ব্যাপারে মানুষকে ভয় না করার উপদেশ দিচ্ছি।
আমি আরও উপদেশ দিচ্ছি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন, জনসাধারণের দেখাশোনা ও তাদেরকে শত্রুদের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য নিজেকে নিয়োজিত করবেন। কখনোই গরিবদের ওপর ধনীদের প্রাধান্য দেবেন না। আল্লাহর ইচ্ছায় এটা আপনার অন্তরের সুস্থতা বজায় রাখবে, গুনাহের বোঝা হালকা করবে; শেষ বিচারের দিন আপনার জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে; যেদিন তিনিই বিচারক হবেন; যিনি আপনার গোপন সবকিছু জানেন, যিনি আপনার ও আপনার অন্তরের মাঝে পর্দা হয়ে থাকেন।
কাছের হোক কিংবা দূরের—আমি আপনাকে নির্দেশ দিচ্ছি সকলের ক্ষেত্রেই আল্লাহর বিধান ও তাঁর সীমারেখার ব্যাপারে কঠোর থাকার। কাউকে তার অন্যায়ের যথোপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে কোনো নম্রতা দেখাবেন না। সকলকে সমান চোখে দেখবেন, অধিকার আদায়ের ব্যাপারে দ্বিধা করবেন না; আল্লাহর ব্যাপারে কোনো নিন্দুকের নিন্দার পরোয়া করবেন না। আল্লাহ যে সম্পদ দিয়েছেন তা বণ্টনের ক্ষেত্রে কোনো পক্ষপাতিত্ব করবেন না, তাহলে অন্যায় অবিচারে লিপ্ত হয়ে পড়বেন। আর পরিণতিতে আল্লাহ যে প্রশস্ততা আপনার জন্য বরাদ্দ করেছিলেন তা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবেন।
আপনার অবস্থান হলো দুনিয়া ও আখিরাতের মাঝে। যদি এ পৃথিবীতে আপনার দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করেন, কোনো অবিচার না করেন, তবে আখিরাতে শান্তি পাবেন। আর যদি কুপ্রবৃত্তিকে প্রাধান্য দেন তবে আল্লাহর শাস্তি অবধারিত। আমি নাসীহাত করছি, আপনি নিজে কিংবা আপনাদের কেউ যেন যিম্মিদের কোনো ক্ষতি না করে। এবং এর বিনিময়ে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখিরাতই আশা করবেন।
আমি আপনাকে সেই নাসীহাতই করেছি যা আমি আমার নিজেকে বা আমার সন্তানকে করতাম। এগুলো মেনে চললে প্রভূত কল্যাণ লাভ করবেন। আর যদি এগুলোকে কোনো গুরুত্ব না দেন বা আল্লাহর সন্তুষ্টি মোতাবেক কাজ না করেন, তবে সেটা হবে এক চরম ব্যর্থতা ও নিষ্ঠাহীনতার জ্বলন্ত প্রমাণ। এটা হবে প্রবৃত্তির অনুসরণ।
ইবলিস হলো সকল পাপের উৎস, সে মানুষকে পাপের দিকে ডাকে, সব সময় মানুষকে জাহান্নামেই নিতে চায়। পূর্ববর্তীদের অনেককে সে পথভ্রষ্ট করে জাহান্নামে নিয়ে গিয়েছে। কতই-না নিকৃষ্ট ঠিকানা সে জাহান্নাম। আল্লাহর শত্রুকে বন্ধু বানিয়ে নেওয়া কতই-না নিকৃষ্ট এক কাজ! যে মানুষকে আল্লাহর অবাধ্যতার দিকে ডাকে। সত্যের সাথে থাকুন, সব সময় সত্যকে মানার চেষ্টা করুন, নিজের ভুলত্রুটি নিয়ে সতর্ক পর্যালোচনা করুন।
আল্লাহর শপথ করে অনুরোধ করছি—মুসলিমদের প্রতি অনুগ্রহশীল থাকবেন, বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান করবেন, যুবকদের প্রতি সহানুভূতিশীল হবেন, জ্ঞানীদের সম্মান করবেন। তাদের কোনো ক্ষতি করবেন না, অপমান করবেন না। সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখবেন না, এটা মানুষের মধ্যে ক্রোধ উসকে দেবে। যথাসময়ে বেতন-ভাতা দিয়ে দেবেন; কাউকে তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করবেন না, তাহলে তারা দরিদ্র হয়ে পড়বে। দীর্ঘ সময়ের জন্য কাউকে অভিযানে নিয়োজিত রাখবেন না, তাহলে শেষ পর্যন্ত তারা সন্তানহীন থেকে যাবে।
ধন-সম্পদ যেন শুধু ধনীদের মধ্যেই আবর্তিত না হয়। দুর্বল জনসাধারণের জন্য সরাসরি আপনার কাছে আসার দরজা বন্ধ করবেন না, তাহলে ক্ষমতাশালীরা দুর্বলদেরকে শেষ করে ফেলবে। আপনার প্রতি এগুলো আমার উপদেশ, আর আপনার ব্যাপারে আল্লাহকেই আমি সাক্ষী রাখলাম। আপনার প্রতি আমার পক্ষ থেকে সালাম।
একনজরে উপদেশগুলোর সামারি
১. সর্বশক্তিমান আল্লাহকে ভয় করো।
২. সকলের ওপর আল্লাহর দন্ডবিধি প্রয়োগ করবে।
৩. ইসলামের ওপর অবিচল থাকবে।
৪. সর্বক্ষেত্রে ন্যয়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে
৫. ইসলামের অগ্রণী ব্যক্তিদের যোগ্য সম্মান করবেন
৬. সেনাবাহিনীর প্রতি যথাযথ নজর রাখবে। তাদের সুবিধা ও ছুটির দিকে খেয়াল রাখবে
৭. সরকারি কর্মচারীদের বেতন ও জনগণের ভাতা যথাসময়ে পরিশোধ করবে।
৮. জিম্মীদের অধিকারের ব্যাপারে খেয়াল রাখবে
৯. উদ্বৃত্ত সম্পদের বাইরে কোনো সম্পদের ওপর যাকাত আরোপ করা যাবে না। জনগণকে অর্থনৈতিক চাপে ফেলা যাবে না।
১০. অধীনস্থ ও সকল জনগণের সাথে ভালো আচরণ করবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন