২৭ অক্টো, ২০২২

খিলাফত পর্ব-৩১ : উসমান রা.-এর সময়ে ইসলামী রাষ্ট্রের গভর্নরগণ

 


খুলাফায়ে রাশেদার মধ্যে উসমান রা. সবচেয়ে বেশি সময় রাষ্ট্রের দায়িত্বে ছিলেন। উসমান রা.-এর সময়ে রাষ্ট্রের সীমানাও ছিল অনেক বেশি। ফলে পুরো রাষ্ট্রটিকে অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত করতে হয়েছিল। প্রতিটি প্রদেশ একজন ওয়ালী বা গভর্নরের অধীনে শাসিত হত। কোন কোন সময় এক প্রদেশ ভেঙ্গে একাধিক প্রদেশ করা হতো, আবার কখনো বা কোন প্রদেশের মর্যাদা বিলুপ্ত করে সেটিকে অন্য প্রদেশের সাথে একীভূত করা হত। 

প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থার প্রধানত তিনটি অঙ্গ ছিল: 
১) বিচার বিভাগ, যা সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিল। খালীফা নিজেই প্রদেশসমূহের কাজী বা বিচারক নিয়োগ করতেন। কখনো বা গভর্ণর প্রাদেশিক বিচারক নিয়োগ দিতেন। মাঝে মাঝে গভর্ণরকে বিচারকের দায়িত্বও পালন করতে হতো। 
২) প্রশাসন বিভাগ, রাজ্য পরিচালনার সামগ্রিক দায়িত্ব ছিল এই বিভাগের ওপর। ওয়ালী বা গভর্ণর হলেন প্রদেশ প্রধান, তিনি সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করতেন। ওয়ালীর সেনাপতিত্বে প্রতি প্রদেশে পৃথক সেনাবাহিনী ছিল। তারা সংশ্লিষ্ট প্রদেশের সন্নিহিত অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করতেন। প্রাদেশিক রাজধানীর কেন্দ্রীয় মসজিদে সালাতের ইমামতি করা ছিল গভর্ণরের অন্যতম দায়িত্ব। 
৩) বাইতুল মাল বা রাজস্ব বিভাগ, প্রাদেশিক গভর্ণর সাধারণত রাজস্ব বিভাগ বা বাইতুল মালের তত্ত্বাবধান করতেন। তবে কখনো কখনো খালীফাগণ দ্বৈত ব্যবস্থা চালু রাখতেন। 

নিম্নে প্রদেশ ও প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের বিবরণ দেওয়া হলো :

মক্কা :
দ্বিতীয় খলীফা উমার রা.-এর শাহাদাতের সময় মক্কার গভর্ণর ছিলেন খালিদ ইবনুল আস রা.। তৃতীয় খালীফা উসমান রা. তাকে কিছুদিন মাক্কার গভর্ণর পদে বহাল রাখেন। তারপর তাঁকে সরিয়ে দেয়া হয়। অপসারণের কোনো কারণ জানা যায় না। খালিদ ইবনুল আসের কীর্তি বা অবদান সম্পর্কেও বিশেষ কিছু জানা যায় না। খালিদকে অপসারণের পর আলী ইবনু রাবী'আহকে মক্কার গভর্ণর পদে নিয়োগ করা হয়। তবে তার দায়িত্বপালনও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এরপর আরো কয়েকজন মক্কার গভর্নর হন। তৃতীয় খলীফার শাসনামলের শেষদিকে বিভিন্ন প্রদেশে বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতা দেখা দিলেও মাক্কায় এর কোন প্রভাব পড়েনি। প্রাচীন এই জনপদে শান্তিশৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা বজায় ছিল।

মদিনা :  
মাদীনাতুল মুনাওয়ারা ছিল খিলাফাতের রাজধানী। খলীফার বাসভবন ও খিলাফাতের সদর দপ্তর ছিল এই শহরে। শীর্ষস্থানীয় সাহাবীগণ এই শহরে অবস্থান করতেন। এখানে আলাদা কোনো প্রশাসক ছিলেন না। খলিফা নিজেই মদিনার তত্ত্বাবধান করতেন। হজ্জ পালনের জন্য মক্কায় গমন করলে উসমান রা. বিশিষ্ট কোন সাহাবীর ওপর দায়িত্ব অর্পণ করতেন। বেশিরভাগ সময় যায়িদ ইবনু সাবিত রা.-এর ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হতো।

আল-বাহরাইন : 
‘উমার রা.-এর শাহাদাতের সময় বাহরাইনের গভর্ণর ছিলেন উসমান ইবনু আবিল ‘আস আস-সাকাফী। উসমান রা.-এর খিলাফাতের প্রথম কয়েক বছরও তিনি ওই পদে বহাল ছিলেন। হিজরী সাতাশ সনে তিনি বাহরাইন হতে বিশাল এক বাহিনী নিয়ে বসরা বাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে বিজয়াভিযানে অংশগ্রহণ করেন। বসরা ও বাহরাইনের এই সংহতি পরবর্তীতে আরো বৃদ্ধি পায়, এক পর্যায়ে বাহরাইনের স্বতন্ত্র প্রদেশের মর্যাদা বিলুপ্ত করা হয় এবং এটি বসরা প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত একটি অঞ্চলে পরিণত হয়। পরবর্তীতে বসরার গভর্ণর ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমিরকে বাহরাইনের শাসনকর্তা নিয়োগ দিতে দেখা যায়। উসমান রা.-এর শাসনামলে যাঁরা বাহরাইন শাসন করেছেন তাদের মধ্যে ছিলেন মারওয়ান ইবনুল হাকাম ও আবদুল্লাহ ইবনু সাওয়ার আল-“আবদী।

আল-ইয়ামান ও হাদরামাউত:
উমার রা.-এর শাহাদাতের সময় ইয়ামানের গভর্ণর ছিলেন ইয়ালা ইবনু মুনইয়াহ। খালীফার নির্দেশ পেয়ে তিনি মাদীনার পথে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে তিনি তৃতীয় খালীফা উসমান রা.-এর পত্র পান, যাতে ‘উমার রা.-এর শাহাদাত ও “উসমান রা.-এর স্থলাভিষিক্ত হওয়ার সংবাদ ছিল। ঐ পত্রবলেই ইয়ালাকে সান'আ শহরের শাসক নিয়োগ করা হয়। তিনি উসমান রা.-এর শাহাদাত পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তবে ইয়ামানের আল-জুদ শহরের শাসক ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনু রাবী'আহ।

ইয়ামানের একদল ইয়াহুদী উসমান রা.-এর আমলের শেষদিকে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে নেপথ্য ভূমিকা পালন করেছে। ঐ ষড়যন্ত্রকারী ইয়াহুদীদের মূল হোতা ছিল আবদুল্লাহ ইবনু সাবা। উসমান রা.-এর শাহাদাতের পর ইয়ালা ইবনু মুনইয়াহ ও আবদুল্লাহ ইবনু রাবীআহসহ ইয়ামানের কয়েকজন শাসক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভূমিকা পালনের জন্য নিজেদের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে হিজাযে চলে আসেন।

সিরিয়া (শাম): খালীফা হিসেবে উসমান রা.-এর অভিষেকের সময় সিরিয়ার বড় অংশের (দামেশক ও জর্দান) শাসক ছিলেন মুআরিয়া ইবনু আবি সুফইয়ান রা.। সেসময় সিরিয়ার কিছু অংশ তার কর্তৃত্বের বাইরে ছিল। তৃতীয় খালীফা উসমান রা.- তাঁকে স্বপদে বহাল রাখেন। কয়েক বছর যেতে না যেতেই মু'আবিয়া রা. সমগ্র সিরিয়ার শাসকে পরিণত হন। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ঘটনাবলি তাঁর এই অর্জনের পথে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে। দ্বিতীয় খালীফা উমার রা.-এর আমলে মু'আবিয়া প্রথমে শুধু দামেশকের শাসক ছিলেন। তাঁর ভাই ইয়াযীদ ছিলেন জর্দানের শাসক; তিনি মারা গেলে "উমার রা. জর্দান অঞ্চল মু'আবিয়া রা.-এর অধীনে ন্যস্ত করেন। 

হিমস ও কিন্নাসরিন অঞ্চলের শাসক ছিলেন উমাইর ইবনু সা'দ আল-আনসারী; মারাত্মক অসুস্থ ও শয্যাশায়ী হয়ে তিনি খালীফা উসমান রা.-এর কাছে দায়িত্ব হতে অব্যাহতি চান। উসমান রা. তার আবেদন মঞ্জুর করেন এবং হিমস ও কিন্নাসরিন মু'আবিয়ার অধীনে ন্যস্ত করেন। আলকামাহ ইবনু মিহরায় ছিলেন ফিলিস্তিনের শাসনকর্তা। তাঁর মৃত্যু হলে খালীফা তদস্থলে নতুন কোন শাসক নিয়োগ না দিয়ে ফিলিস্তিনও মু'আবিয়ার অধীনে ন্যস্ত করেন। এভাবে দু'বছরের মাঝে মু'আবিয়া সমগ্র সিরিয়ার (দামেশক, হিমস, কিন্নাসরিন, ফিলিস্তিন ও জর্দান) একমাত্র শাসকে পরিণত হন। উসমান রা.-এর শাহাদাত পর্যন্ত তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তৃতীয় খালীফার আমলে তিনি ছিলেন সবচেয়ে বড় প্রদেশের সর্বাধিক প্রতাপশালী গভর্ণর।

মিশর:
উমার রা.-এর ‘আমলে মিসরের গভর্ণর ছিলেন আমর ইবনুল আস রা.। উসমান রা.-ও কিছুদিন তাকে স্বপদে বহাল রাখেন। কোন কোন অঞ্চলে 'আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ ইবনু আবি সারাহ গভর্ণর আমরকে রাজস্ব আদায়ে সহায়তা করতেন। 'আবদুল্লাহ ছিলেন 'আমর ইবনুল আসের দীর্ঘ অভিযানের সাথী। 'আমর ফিলিস্তিন হতে শুরু করে মিসর পর্যন্ত যে দীর্ঘ বিজয়াভিযান পরিচালনা করেন তাতে ‘আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ ছিলেন তার যোগ্য সহযোদ্ধা। উমার রা. আবদুল্লাহ ইবনু সা'দকে মিশরের কিছু অংশের শাসক নিযুক্ত করেছিলেন। এই ব্যবস্থা উসমান রা.-এর আমলের শুরুর দিকেও বহাল ছিলো। কিছুদিন পর মিসরের কতিপয় অধিবাসী শাসক হিসেবে আমরের কঠোরতার ব্যাপারে উসমান রা.-এর কাছে অভিযোগ করে। 

তাছাড়া আমর রা.-এর আমলে রাজস্ব আয়ে ঘাটতি দেখা দেয়। তাই উসমান রা. গভর্ণর আমরের কর্তৃত্ব খর্ব করে তাকে শুধু সালাতে ইমামতির দায়িত্ব দেন এবং আবদুল্লাহ ইবনু সা'দকে প্রতিরক্ষা ও রাজস্ব বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। শীঘ্রই এই নিয়োগের সুফল পাওয়া যায়। আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ দায়িত্ব গ্রহণের পর মিসরের রাজস্ব আয় বেড়ে যায়। তবে কিছুদিনের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিগত কারণে আমর ও ‘আবদুল্লাহর মাঝে মনোমালিন্য হয়। তখন আমর ইবনুল আস রা. মাদীনায় এসে খালীফাকে বিষয়টি অবহিত করেন এবং আবদুল্লাহ ইবনু সা'দকে অপসারণের অনুরোধ করেন। উসমান রা. এই বলে 'আমর রা.-এর অনুরোধ উপেক্ষা করেন যে, আবদুল্লাহ ইবনু সা'দকে পূর্ববর্তী খালীফা উমার রা. নিয়োগ দিয়েছিলেন। তাছাড়া এমন কোন নৈতিক পদস্খলনের ঘটনা ঘটেনি যে, তাকে অপসারণ করতে হবে। আমর আবারো অনুরোধ করলেন, খালীফাও যথারীতি প্রত্যাখ্যান করলেন। 'আমর তার দাবিতে অটল, খালীফাও তার সিদ্ধান্তে অটল। শেষ পর্যন্ত উসমান রা. মনে করলেন ‘আমরকে সরিয়ে ‘আবদুল্লাহ ইবনু সা'দকে মিসরের গভর্ণর পদে নিয়োগ করাই যথার্থ। কার্যত তিনি তাই করলেন; মিসরের গভর্ণর পদে পদচ্যুত ‘আমর ইবনুল 'আসের স্থলাভিষিক্ত হলেন ‘আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ ইবনু আবি সারহ।।

ইতোমধ্যে মিসরে বিরাট দুর্যোগ সৃষ্টি হয়ে গেল। রোমানরা আলেকজান্দ্রিয়া দখল করে ব্যাপকহারে মুসলিম নিধন করেছে। রোমানদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য 'আমর ইবনুল 'আসের চেয়ে অভিজ্ঞ ও দক্ষ কেউ ছিল না। তাই খালীফা 'আমরকে পুনরায় মিসরে প্রেরণ করলেন, তবে এবার গভর্ণর হিসেবে নয় বরং সেনাপতি হিসেবে। ব্যক্তিগত প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির চিন্তা ঝেড়ে ফেলে ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা সুরক্ষিত করার স্বার্থে আমর এই গুরুদায়িত্ব পালন করলেন এবং রোমান বাহিনীকে পরাজিত করে আলেকজান্দ্রিয়া পুনর্দখল করলেন। যুদ্ধশেষে উসমান রা. মিসরে দ্বৈত-কর্তৃত্ব ব্যবস্থা চালু করতে মনস্থির করেন। তিনি আমর ইবনুল আসকে সেনাপতি ও আবদুল্লাহ ইবনু সা'দকে রাজস্ব বিভাগের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমর আংশিক কর্তৃত্ব গ্রহণে রাজি হননি। ফলে আবদুল্লাহ ইবনু সা'দ মিসরের পূর্ণ গভর্ণর হিসেবে বহাল থাকেন।

বসরা : 
দ্বিতীয় খলীফা উমার রা.-এর আমলেই বসরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শহরে পরিণত হয়। আরবের বিভিন্ন প্রান্ত হতে অনেক গোত্রের লোক বসরায় হিজরত করে। বসরায় ছিল বিশাল সেনাবাহিনী, যার সদস্যরা ইসলামী রাষ্ট্রের প্রাচ্যমুখী সম্প্রসারণের অভিযানগুলোতে অংশগ্রহণ করতেন। বিভিন্ন বিজয়াভিযানে ধৃত বিপুল সংখ্যক বন্দীর আবাসস্থলও ছিল বসরা। ফলে সত্যিকার অর্থে বসরা একটি বহুজাতিক আন্তর্জাতিক নগরীতে পরিণত হয়েছিল। 

বসরার গুরুত্ব উপলব্ধি করে উমার রা. আবু মূসা আল-আশ'আরী রা.-কে বসরার গভর্ণর নিয়োগ করেছিলেন এবং পরবর্তী খালীফাকে ওসিয়ত করেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর বসরার গভর্ণরকে যেন কমপক্ষে চার বছর স্বপদে বহাল রাখা হয়। গভর্ণর হিসেবে আবু মূসা আল-আশ'আরী রা. বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। উমার রা.-এর আমলে তিনি খিলাফাতের প্রাচ্যমুখী সম্প্রসারণে বিপুল অবদান রাখেন। তিনি পারস্যের বিভিন্ন অঞ্চল জয় করেন এবং বিজিত অঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন। বসরার অবকাঠামোগত উন্নয়নেও আবু মূসার অবদান রয়েছে। নগরবাসীর সুপেয় পানির প্রয়োজন মেটাতে তিনি নালা কেটে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। তবে এই কাজ সম্পন্ন হওয়ার আগেই তিনি অপসারিত হন। উসমান (রা.)-এর অধীনে ছয় বছর কাজ করার পর তাকে অপসারণ করা হয়। হিজরী উনত্রিশ সনে বসরার গভর্ণরের পদ হতে আবু মূসা আল-আশ'আরী রা.-কে প্রত্যাহার করে তদস্থলে ‘আবদুল্লাহ ইবনু 'আমির ইবনি কুরাইযকে নিয়োগ করা হয়। আবু মূসা আল-আশ'আরীর অপসারণের কারণ সম্পর্কে যা জানা যায় তা হলো তার একটি সিদ্ধান্তের কারণে তিনি সেনাবাহিনীর একদল সদস্যের বিরাগভাজন হন। 

কুফা : 
উমার রা.-এর শাহদাতের সময় কুফার গভর্নর ছিলেন মুগিরা বিন শুবা রা.। তিনি তখন মদিনায় ছিলেন। উমার রা. অসিয়ত করেন কুফায় যেন সা'দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা.-কে গভর্নর করা হয়। সা'দ ছিলেন কুফা নগরীর প্রতিষ্ঠাতা। অসিয়ত অনুসারে উসমান রা. তাঁকে গভর্নর নিয়োগ করলেন। তবে তিনি সেখানে দ্বৈত-শাসন চালু করলেন। সা'দ রা.-কে সেনাবাহিনী প্রধান ও ইমামতির দায়িত্ব দিলেন। আর আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-কে দিলেন বাইতুল মাল বা রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব।  

কুফায় গভর্ণর সা'দ রা.-এর কার্যকাল দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। রাজস্ব প্রধান আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ রা.-এর সাথে মতবিরোধের প্রেক্ষিতে মাত্র দেড় বছর পর সা'দ রা. অপসারিত হন। ঘটনার বিবরণে জানা যায়, গভর্ণর সা'দ রা. বাইতুল মাল হতে কিছু অর্থ কর্জ করেছিলেন। নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেলেও তিনি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হন। ইবনু মাসউদ রা. তাঁর কাছে কৈফিয়ত তলব করেন। এই সময় দু'জনের মাঝে তর্ক হয়, যা উপস্থিত জনতা প্রত্যক্ষ করে। বিষয়টি খলীফার কাছে উপস্থাপিত হলে তিনি সা'দ রা.-কে অপসারণ করেন এবং ইবনু মাসউদ রা.-কে স্বপদে বহাল রাখেন। সা'দ রা.-কে অপসারণের পর আল-ওয়ালীদ ইবনু উকবা ইবনি আবি মু'আইতকে কুফার গভর্ণর পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি আবু বাকর রা.-এর আমলে বাহিনী প্রধান হিসেবে জর্দানে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। উমার রা. তাঁকে “আরব আল-জাযীরায় সরকারী কাজে নিযুক্ত করেছিলেন।

আল ওয়ালিদের বিরুদ্ধে মদ্যপানের অভিযোগ আসলে তাকে অপসারণ করে সাঈদ ইবনুল আস রা.-কে কুফার গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। কুফাবাসী বার বার শাসককদের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনতে লাগলো। তারা এবার সাঈদ অবনুল আসের বিরুদ্ধে অনাস্থা এনে আবু মুসা আল-আশ'আরী রা.-কে নিয়োগ দেয়ার জন্য দাবী করলো খলিফার কাছে। খলিফা উসমান রা. তাদের এই দাবিও পূরণ করেন। কুফায় আবু মুসা আল-আশ'আরী রা.-কে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেন।  

আর্মেনিয়া:
উসমান রা.-এর আমলে বিজিত অঞ্চলগুলোর অন্যতম হল আর্মেনিয়া। খলীফার নির্দেশে সিরিয়ার গভর্ণর মু'আবিয়া সেনাপতি হাবীব ইবনু মাসলামা আল ফিহরীর নেতৃত্বে আট হাজার সৈন্যের একটি দল আর্মেনিয়ায় প্রেরণ করেন। হাবীব আর্মেনিয়ার অনেকগুলো অঞ্চল জয় করেন। তারপর রোমানদেরকে আর্মেনিয়াবাসীর সমর্থনে এগিয়ে আসতে দেখে খলীফার কাছে অতিরিক্ত ফৌজ চাইলেন। কুফা থেকে সালমান ইবনু রাবী'আহ-এর নেতৃত্বে ৬ হাজার সদস্যের একটি বাহিনী আর্মেনিয়ায় পৌঁছল। কুফা ও সিরিয়া ব্রিগেডের যৌথবাহিনী খাযার রাজ্যের অনেকাংশ জয় করলেন। পরবর্তীতে খাযার রাজ তিন লক্ষ সৈনিকের এক বাহিনী নিয়ে এগিয়ে এলে দশ হাজার সৈন্যের মুসলিম বাহিনী সালমান ইবনু রাবী'আহ-এর নেতৃত্বে মরণপণ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। যুদ্ধে সালমান শহীদ হন এবং মুসলিম বাহিনী চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়।

কিছুদিন পর উসমান রা. সেনাপতি হাবীবকে আবার আর্মেনিয়ায় প্রেরণ করেন; তিনি কিছু এলাকা জয় করেন এবং স্থানীয়দের সাথে অনেকগুলো চুক্তি করেন। আজারবাইজানের শাসক ছিলেন হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান। উসমান রা. তাকে আর্মেনিয়ারও শাসক নিযুক্ত করেন। তিনি খাযার অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে কিছু এলাকা জয় করেন। এক বছর পর হুযাইফাকে প্রত্যাহার করে আল-মুগীরা ইবনু শু'বাকে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের গভর্ণর নিযুক্ত করা হয়। উসমান রা.-এর শাহাদাতের সময় আল-মুগীরা স্বপদে বহাল ছিলেন। 

এছাড়া তায়েফের গভর্নর ছিলেন আল কাসিম ইবনু রাবিআ, কারকাসিয়ায় জারির ইবনু আব্দুল্লাহ, হালাওয়ানে উতবা ইবনু নাহাস, হামাজানে আন নাসীর, ইস্ফাহানে আস সাইব ইবনুল আকরা এবং মাসাবযানে ঘাবিশ সামরিক কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন