উসমান রা. দায়িত্ব গ্রহণের আগে যারা গভর্নর ছিলেন তাদের প্রত্যেককেই তিনি দায়িত্বে বহাল রাখেন। কিছু বছর যাওয়ার পর প্রয়োজনের আলোকে পরিবর্তন হয়। উসমান রা. প্রাদেশিক শাসনকর্তাদেরকে সীমাহীন ক্ষমতা চর্চার সুযোগ দেননি। বরং সময়ে সময়ে পত্র প্রেরণ ও ফরমান জারির মাধ্যমে তাদেরকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন। এক্ষেত্রে মাদীনায় অবস্থানরত সাহাবীগণের সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে তিনি কাজ করতেন। আদল ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা এবং জনকল্যাণে কাজ করতে তিনি বারংবার তাকিদ দিতেন।
গভর্ণরদের উদ্দেশে প্রেরিত তাঁর প্রথম পত্রটিতে তিনি বলেন, //নিশ্চয়ই আল্লাহ শাসকদেরকে তত্ত্বাবধায়ক হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কর আদায়কারী বলে শাসকদেরকে আল্লাহ অগ্রাধিকার দেননি। এই উম্মাহর অগ্রবর্তীদেরকে আল্লাহ দায়িত্বশীল হিসেবে সৃষ্টি করেছেন, কর আদায়কারী হিসেবে সৃষ্টি করেননি। আমার আশঙ্কা তোমরা শাসকরা তত্ত্বাবধায়ক হওয়ার বদলে যেন কর আদায়কারী না হয়ে পড়ো। তোমরা যদি কর আদায়কারী হয়ে পড়, তবে লজ্জাশীলতা, আমানতদারী ও বিশ্বস্ততার অবসান হবে। সাবধান! তোমরা মুসলিমদের ব্যাপারে মনোযোগী হবে, তাদেরকে তাদের প্রাপ্য প্রদান করবে এবং রাষ্ট্রের প্রাপ্য তাদের কাছ থেকে আদায় করবে। অতঃপর তোমরা জিম্মীদের ব্যাপারে মনোযোগী হবে, তাদের প্রাপ্য তাদেরকে প্রদান করবে আর রাষ্ট্রের পাওনা তাদের কাছ থেকে আদায় করবে। অতঃপর আমি শক্রদের ব্যাপারে বলছি যাদের ওপর তোমরা আঘাত হেনে থাকো, তাদের ভূমি তোমরা উন্মোচন করবে বিশ্বস্ততার সাথে।//
প্রাদেশিক শাসকদের কার্যকলাপ তদারক করার জন্য উসমান রা. যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন সেগুলো হলো:
ক. হাজ্জ সম্মিলন:
হাজ্জ আদায়ের পর গভর্ণরদের সাথে বৈঠকের রেওয়াজ দ্বিতীয় খালীফা উমার রা. চালু করেছিলেন। উসমান রা. এই প্রথা বহাল রেখেছিলেন। তিনি প্রাদেশিক শাসনকর্তাদেরকে প্রতি বছর হাজ্জ আদায়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন। হাজ্জ সমাপনান্তে তিনি গভর্ণরদের সাথে বার্ষিক সম্মেলনে মিলিত হতেন। সর্বসাধারণের এই অনুমতি ছিল যে, তারা গভর্ণরের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকলে তা খালীফার কাছে পেশ করতে পারবে। "উসমান রা. অভিযোগগুলোর তাৎক্ষণিক প্রতিকার করতেন।
খ. নাগরিকের সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ:
রাষ্ট্রের রাজধানী ছিল মাদীনা। ইসলামী রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রান্ত হতে নাগরিকগণ নানা প্রয়োজনে, ভ্রমণের উদ্দেশ্যে কিংবা জ্ঞান চর্চার জন্য রাজধানীতে আসতেন। খালীফা আগত নাগরিকদের কাছ থেকে প্রদেশগুলোর তথ্য সংগ্রহ করতেন। তাছাড়া সাধারণ নাগরিকদেরও খলীফার সাথে দেখা করার অবাধ সুযোগ ছিল। তারা প্রদেশের অবস্থা সম্পর্কে খলীফাকে অবহিত করতেন। কোন শাসনকর্তার ব্যাপারে অভিযোগ থাকলে তা নিঃসঙ্কোচে ব্যক্ত করতেন। অভিযোগের সত্যাসত্য যাচাই করে খলীফা পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন।
গ. নাগরিকদের পত্র:
বিভিন্ন প্রদেশ হতে নাগরিকরা এককভাবে বা সমষ্টিগতভাবে খালীফার কাছে পত্র লিখতেন। উসমান রা.-এর আমলে কুফা, মিসর ও সিরিয়াবাসীর কাছ থেকে মাদীনায় পত্র প্রেরণের কথা ইতিহাসে জানা যায়। উসমান রা. পত্রগুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন।
ঘ, সফর:
উসমান রা. মাঝে মাঝে সরকারি সফরে বিভিন্ন প্রদেশে যেতেন এবং স্বচক্ষে জনগণের অবস্থা দেখতেন। প্রদেশের সামগ্রিক অবস্থা দেখতেন, গভর্নরদের কার্যকলাপ দেখতেন। প্রদেশের কোনো উন্নয়ন কাজের প্রয়োজন হলে তার ব্যবস্থা নিতেন।
ঙ. বিভিন্ন প্রদেশে তথ্যানুসন্ধানে গোয়েন্দা দল প্রেরণ:
উসমান রা. মাঝে মাঝে নানা প্রদেশে তথ্যানুসন্ধান করার দল প্রেরণ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তিনি ‘আম্মার ইবনু ইয়াসির রা.-কে মিসরে, মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামা রা.-কে কুফায়, উসামা ইবনু যায়িদ রা.-কে বাসরায় এবং আবদুল্লাহ ইবনু “উমার রা.-কে সিরিয়ায় প্রেরণ করেছিলেন। তাছাড়া আরো অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে তিনি অন্যান্য প্রদেশে পাঠিয়েছেন। এই প্রতিনিধিরা প্রদেশগুলোর অবস্থা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে খলীফার কাছে প্রতিবেদন পেশ করতেন। খলীফা পরিস্থিতির আলোকে পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন।
চ. গভর্ণরদেরকে রাজধানীতে তলব:
প্রতি বছর হাজ্জ মৌসুমে খলীফার সভাপতিত্বে গভর্ণরদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হত। তাছাড়া সারা বছরই খলীফা ও গভর্ণরদের মাঝে পত্র বিনিময় হত। মাঝে মাঝে এমন পরিস্থিতি উদ্ভব হত যে খলীফা জরুরি ভিত্তিতে প্রাদেশিক শাসনকর্তাদেরকে রাজধানীতে তলব করতেন। তাদের সাথে পরামর্শ করতেন।
ছ. প্রতিনিধি প্রেরণে গভর্ণরদের নির্দেশ
খুলাফা রাশিদূন প্রাদেশিক শাসনকর্তাদেরকে নির্দেশ দিতেন তারা যেন রাজধানীতে প্রতিনিধিদল প্রেরণ করেন। এদের কাছ থেকে খালীফাগণ বিভিন্ন প্রদেশের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে তথ্য লাভ করতেন। তাঁদের আবেদন-অভিযোগ খলিফা শুনেছেন এবং প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।
উসমান রা. গভর্নরদের ব্যাপারে সজাগ ছিলেন ও সচেতন ছিলেন। যখনই কোন গভর্ণরের শৈথিল্য বা ত্রুটি তার নজরে আসত তিনি কালবিলম্ব না করে তাকে সাবধান করতেন। ক্ষেত্রবিশেষে কঠোর পদক্ষেপও গ্রহণ করতেন। এক্ষেত্রে ঐ গভর্ণর সম্পর্কে তার সুধারণা বা আত্মীয়তার সম্পর্ক প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারত না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আল-ওয়ালীদ ইবনু উকবার কথা। কুফার এই শাসক ‘উসমান রা.-এর আত্মীয় ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষীরা এই সাক্ষ্য দিল যে তিনি মদ পান করেছেন। তখন উসমান রা. আত্মীয়তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে আল-ওয়ালীদের ওপর মদ্যপানের হদ কায়েম করলেন। পরবর্তীতে তাকে কুফার গভর্ণরের পদ হতে অপসারণ করেন।
গভর্নরদের দায়িত্ব ও কর্তব্য:
সকল গভর্নরের কতৃত্ব সমান ছিল না। আগে গভর্নরদের পূর্ণ কর্তৃত্ব দেওয়া হতো। উমার রা. আমল থেকে প্রয়োজন অনুসারে দ্বৈত শাসনের পদ্ধতি চালু হয়। পূর্ণ কর্তৃত্বের অধিকারী গভর্নরকে মৌলিকভাবে চারটি দায়িত্ব পালন করতে হত,
১) প্রাদেশিক রাজধানীর কেন্দ্রীয় মসজিদে সালাতে ইমামতি;
২) প্রাদেশিক সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে সীমান্ত সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের ব্যবস্থা গ্রহণ;
৩) প্রদেশের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে কোষাগারের আয়-ব্যয় তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ;
৪) কাজী বা বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন।
আংশিক কর্তৃত্বের অধিকারী গভর্নরগণ ঠিক ততটুকু ক্ষমতাপ্রাপ্ত হতেন যতটুকু ক্ষমতাসহ তাদেরকে নিয়োগ দেওয়া হত।
আল কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে শাসকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বলা হয়েছে :
আমি তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত দেবে, এবং সৎকার্যের নির্দেশ দেবে ও অসৎকার্য হতে নিষেধ করবে। আর সকল কর্মের পরিণাম আল্লাহর ইখতিয়ারে। [আল কুরআন ২২:৪১] কুরআনে মুসলিম শাসকদের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে নির্দেশনা সম্বলিত আরো আয়াত রয়েছে। এসব আয়াত ও আস-সুন্নাহর নির্দেশনার আলোকে গভর্ণরগণ নিম্নলিখিত দায়িত্ব পালন করতেন।
ইকামাতে দ্বীন বা দ্বীন প্রতিষ্ঠা ছিল মুসলিম শাসকদের সর্বপ্রধান কর্তব্য। আল্লাহ আ'আলা বলেন, তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন দ্বীন, যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি নূহকে, আর যা আমি ওহী করেছি তোমাকে এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে, এই বলে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করো এবং তাতে মতভেদ করো না। [আল কুরআন ৪২:১৩।]
আল কুরআনের নির্দেশানুসারে দ্বীন কায়েম করতে গিয়ে গভর্ণরগণ নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতেন।
১. দ্বীনের প্রচার ও প্রসার:
দ্বীন প্রতিষ্ঠার প্রারম্ভিক কাজ হলো দ্বীনের প্রচার ও প্রসারে দাওয়াতী কার্যক্রম জোরদার করা। এটি ছিল অন্যতম বুনিয়াদি কাজ, যা খলীফা ও তার গভর্নরগণ ব্যবস্থা করতেন। দ্বীনী দাওয়াত সম্প্রসারণের একটি প্রভাবক উপায় ছিল রাজ্যবিজয়। কোন অঞ্চলে প্রথমেই হামলা করা হত না বরং ওই অঞ্চলের বাসিন্দাদেরকে দ্বীন কবুলের জন্য উদাত্ত আহবান জানানো হত। সেই আহবানে সাড়া দিলে সবার মাঝে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক সৃষ্টি হত। দ্বীনের দাওয়াত কবুল না করলেও জিজিয়া দিতে রাজি হলে সামরিক অভিযান চালানো হত না। দ্বীনের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করলে আল্লাহর বান্দাদেরকে মানুষের দাসত্বের নিগড় থেকে মুক্ত করার জন্য অভিযান পরিচালিত হত। বিজিত অঞ্চলে নবদীক্ষিত মুসলিমদের দ্বীন শিক্ষা দেওয়ার জন্য মু'আল্লিম (প্রশিক্ষক) ও মুবাল্লিগ (প্রচারক) নিয়োজিত থাকতেন। এরা জনগণকে ইসলামের বিশুদ্ধ আকীদা, ইবাদাত ও মু'আমালাত পদ্ধতি শিক্ষা দিতেন।
২. সালাত কায়েম করা:
নবদীক্ষিত মুসলিমকে সর্বাগ্রে সালাত আদায় পদ্ধতি শিক্ষা দেওয়া হতো। সালাত আদায়ের জন্য প্রতি শহরে প্রয়োজনীয় সংখ্যক মাসজিদ নির্মিত হয়েছিল। মদিনার মসজিদে নববীতে খালীফা নিজে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে ইমামতি করতেন। তিনি জুমু'আ ও ঈদের সালাতে খুতবা দিতেন ও ইমামতি করতেন। প্রাদেশিক শহরের কেন্দ্রীয় মসজিদে গভর্ণরের ইমামতিতে সালাত আদায় করা হত। এভাবে সালাত আদায়ের মাধ্যমে একটি পবিত্র সমাজ গড়ে ওঠেছিল। সালাত ত্যাগকারীদেরকে সদুপদেশ দিয়ে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করা হতো। এই প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হতো।
৩. দ্বীনের মূলনীতি সংরক্ষণ:
যেসব মূলনীতির ওপর এই দ্বীনের সৌধ প্রতিষ্ঠিত খুলাফা রাশিদূন ও তাদের গভর্ণরগণ সর্বদা সেগুলো সংরক্ষণ ও সমুন্নত রাখতে সচেষ্ট থাকতেন। সহীহ আকীদা বিশ্বাসের প্রচার ও শির্ক-বিদ'আত প্রতিরোধে তারা সদা তৎপর থাকতেন।
৪. মাসজিদ নির্মাণ:
হিজরাতের পথে কুবায় পৌঁছে রাসূলুল্লাহ সা. ইসলামের ইতিহাসের প্রথম মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। ইয়াসরিবে পৌঁছেও তিনি সর্বপ্রথম যে কাজ করেন তা হল মাসজিদ নির্মাণ। রাসূলুল্লাহ সা.-এর অনুসরণে খলীফা ও গভর্ণরগণ অনুরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন। বিজিত অঞ্চলে শাসকগণ মসজিদ নির্মাণ করতেন। শহরগুলোর সকল মসজিদ হয়তো গভর্ণর নির্মাণ করতেন না। কিন্তু প্রধান মসজিদ গভর্ণর নির্মাণ করতেন। রাষ্ট্রীয় খরচ ব্যতীত কেবল জনগণের স্বেচ্ছাশ্রম এবং দানেও অনেক মাসজিদ নির্মিত হয়েছে।
৫. যাকাত আদায়:
যাকাত আদায় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক ইবাদাত। রাসূলুল্লাহ সা. রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত আদায় করতেন। খুলাফা রাশিদূনের আমলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত আদায় করা হত। প্রদেশগুলোতে গভর্ণরগণ রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত আদায়ের ব্যবস্থা করতেন এবং আল কুরআনের নির্দেশ অনুসারে তা বিলি-বণ্টন করতেন।
৬. হাজ্জ কার্যক্রম সহজীকরণ:
খুলাফা রাশিদূনের আমলে হাজ্জ যাত্রীদের সহায়তা করা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের অন্ত ভুক্ত ছিল। গভর্ণরগণ হাজীদের চলাচলের রাস্তার নিরাপত্তা বিধান করতেন। হাজ্জযাত্রীরা দল বেঁধে মাক্কায় গমন করতেন। প্রাদেশিক শাসকগণ হাজ্জ কাফিলার আমীর নিয়োগ করতেন। হাজ্জে রওয়ানার পূর্বে গভর্ণরের অনুমতি নেওয়ার প্রথা ছিল। হাজ্জের সফর সহজ ও আরামপ্রদ করার জন্য গভর্ণররা আরো কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন। উসমান রা.-এর আমলে বসরার গভর্ণর ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমির। তিনি বসরা থেকে মক্কা যাওয়ার পথে বিভিন্ন স্থানে হাজ্জযাত্রীদের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করেছিলেন। ফাকীহগণ পরবর্তীতে মত প্রকাশ করেছেন যে, হাজ্জ ব্যবস্থাপনা সহজীকরণ শাসকদের অন্যতম দায়িত্ব।
৭. শারঈ হদ প্রয়োগ করা:
মানব সমাজের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য আল কুরআনে কিছু গুরুতর অপরাধের শাস্তির বিধান রয়েছে। এই শাস্তি প্রয়োগের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। খুলাফা রাশিদূন আল কুরআনে নির্দেশিত হদ প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতেন। প্রাদেশিক গভর্ণররা নিজ নিজ প্রদেশে অনুরূপ দায়িত্ব পালন করতেন। এক্ষেত্রে শারঈ বিধান সমুন্নত রাখার চেতনা ব্যতীত অন্য কোন বিবেচনা প্রাধান্য পেত না।
৮. জনগণের জান-মাল ও সম্মানের নিরাপত্তা বিধান:
জনগণের জান-মাল ও ইজ্জত-আব্রুর হিফাযাত করতেন গভর্ণরগণ। এই লক্ষ্যে দ্বিমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হত: আল কুরআন ও আস-সুন্নাহ’র নির্দেশনার আলোকে মানুষের অধিকার ও মর্যাদার বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা হত এবং খ) প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হতো। স্বর্ণযুগের মুসলিমগণ পারস্পরিক অধিকার সম্পর্কে এত বেশি সচেতন ছিলেন তারা অপরের অধিকারে হস্তক্ষেপ করতেন না। অপর ভাইয়ের জান-মাল ও ইজ্জত-আব্রু হিফাযাতকে নিজের দায়িত্ব মনে করতেন। মানুষের অধিকার হরণকারী বা নিরাপত্তা বিঘ্নকারী কোন অপরাধ সংঘটিত হলে দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হত, যা মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করত। দৈহিক ও আর্থিক নিরাপত্তার পাশাপাশি ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তা বিধান করা হত।
৯. আল-জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ:
গভর্ণরগণ প্রদেশের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন, পাশাপাশি তারা মাসজিদে সালাতের ইমামতি করতেন। শুধু তাই নয়, প্রদেশের প্রধান সেনাপতি হিসেবেও তারাই দায়িত্ব পালন করতেন। জিহাদের ময়দানে তাদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী। পরিচালিত হত। বিজয়াভিযানগুলো প্রাদেশিক গভর্ণরদের নেতৃত্বে পরিচালিত হতো। জিহাদের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে গভর্ণরগণ নিম্নলিখিত দায়িত্বসমূহ পালন করতেন।
ক. স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রেরণ:
ইসলামী রাষ্ট্রের কিছু কিছু প্রদেশ অমুসলিম রাজ্যের সীমান্ত সংলগ্ন ছিল না; যেমন- মাক্কা, ইয়ামান, বাহরাইন, ওমান ইত্যাদি। এসব অঞ্চল হতে সরাসরি অভিযান পরিচালনার সুযোগ ছিল না। গভর্ণরগণ তাঁদের প্রদেশের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে সীমান্তবর্তী প্রদেশগুলোতে প্রেরণ করতেন। যাতে স্বেচ্ছাসেবকরা জিহাদে অংশগ্রহণ করতে পারে। জিহাদে অংশগ্রহনেচ্ছু মুজাহিদদের বস্তুগত সহায়তা দেওয়া হত প্রদেশের পক্ষ থেকে।
খ. শক্রদের হামলা হতে সীমান্তের সুরক্ষা:
সীমান্তবর্তী প্রদেশগুলো প্রায়শ শত্রুর আক্রমণের শিকার হত, গভর্ণরগণ সীমান্ত বর্ধিতকরণের পাশাপাশি সীমান্ত সুরক্ষার পদক্ষেপও গ্রহণ করতেন। সিরিয়ার শাসক মু'আবিয়া রোমানদের হামলা হতে সীমান্ত রক্ষার জন্য ব্যতিব্যস্ত ছিলেন। বসরার শাসকও সীমান্ত সুরক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
গ. বসতিস্থাপনের জন্য জায়গীর প্রদান:
জনশূন্য এলাকাগুলো আবাদের জন্য আগ্রহীদেরকে জায়গীর প্রদানের ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন উসমান রা.। গভর্ণরগণ তাঁর নির্দেশে ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন।
ঘ. শত্রুদের খবরাখবর অনুসন্ধান:
গোয়েন্দা বিভাগ নামে স্বতন্ত্র কোন বিভাগ ছিল না সেকালে। তবে গভর্ণরের অধীনে কিছু গোয়েন্দা কাজ করতেন। এদের অনেকে শক্রদের গতিবিধি ও যুদ্ধপ্রস্তুতির ওপর নজরদারি করতেন। নাগরিকদের খোঁজ-খবর রাখতেন।
ঙ. ঘোড়া ও অশ্বারোহী বাহিনী পরিচালনা:
রাসূলুল্লাহ সা.-এর সময়েই অশ্বপালন ও অশ্বারোহন চর্চার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। উমার রা. সকল প্রদেশে অশ্বশালা প্রতিষ্ঠা করেন। উসমান রা.-ও পূর্ববর্তী খলীফার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। প্রতি প্রদেশেই অশ্বশালা ছিল। এসব খামারে পালিত ঘোড়া যুদ্ধের ময়দানে বিরাট ভূমিকা পালন করতো। এসব ঘোড়ার আস্তাবলে সৈনিকরা প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ পেত।
চ. তরুণদের প্রশিক্ষণ প্রদান;
এটি ছিল জিহাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে যেন জিহাদের চেতনা জাগরুক থাকে সেই লক্ষ্যে তরুণদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। এই কর্মসূচির দু'টো অংশ ছিল: মানসিক প্রস্তুতি ও দৈহিক প্রস্তুতি। জিহাদের গুরুত্ব ও মুজাহিদের মর্যাদার বিষয়ে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচির মাধ্যমে তরুণদেরকে জিহাদের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হত। পাশাপাশি শরীর চর্চা, ব্যায়াম, তীর চালনা প্রশিক্ষণ, ঘোড়সওয়ার প্রশিক্ষণ ইত্যাদির মাধ্যমে তাদেরকে দৈহিকভাবে জিহাদের জন্য প্রস্তুত করা হতো।
ছ. সেনাবাহিনীর জন্য পৃথক দফতর স্থাপন:
ইসলামের প্রাথমিক যুগে সেনাবাহিনী পরিচালনার জন্য পৃথক দফতর ছিল না। তাৎক্ষণিকভাবে আগ্রহী যোদ্ধাদের অন্তর্ভুক্ত করে সেনাবাহিনী গঠন করা হত। দ্বিতীয় খালীফা উমার রা. সর্বপ্রথম প্রতিরক্ষা বিভাগ স্থাপন করেন, কেন্দ্রে খালীফা ও প্রদেশে গভর্ণররা এর তত্ত্বাবধান করতেন। উসমান রা.-এর আমলেও এই ব্যবস্থা চালু ছিল। এই দফতরের কার্যপরিধির আওতায় ছিল সৈনিক সংগ্রহ, সামরিক বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ ইত্যাদি।
১০. চুক্তি বাস্তবায়ন:
মুসলিম শাসকরা বিভিন্ন শাসকদের সাথে চুক্তি করতেন। শুধু তাই নয়, ইসলামী বিজয়াভিযানের পদ্ধতিই ছিল এই যে, মুসলিম বাহিনী প্রথমে সামরিক অভিযান না চালিয়ে শত্রু পক্ষকে সন্ধি করার আহবান জানাতে। বিপক্ষ দল এই আহবানে সাড়া দিলে কোন অভিযান পরিচালনার প্রয়োজন হত না। খলীফার পক্ষ থেকে প্রাদেশিক গভর্ণরগণ চুক্তি স্বাক্ষর করতেন। তারাই চুক্তি বাস্তবায়ন ও পালনের ব্যাপারে দায়িত্বশীল ছিলেন।
১১. জনগণের জীবিকার বন্দোবস্ত করা:
একটি সমন্বিত ও মধ্যপন্থি আর্থিক ব্যর্থস্থাপনা প্রচলিত ছিল সে সময়। সম্পদের ওপর ব্যক্তির মালিকানা স্বীকৃত ছিল। জনগণ নিজস্ব মালিকানায় কৃষিকাজ, শিল্পকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করতেন। তবে বাইতুল মাল হতেও বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষকে ভাতা দেওয়া হত। উমার রা.-এর আমলে এই ব্যবস্থাপনা চালু হয়। পরবর্তীতে উন্নয়ন ও সংস্কার সাধনের মাধ্যমে এটি চালু রাখা। হয়। কেন্দ্রে খালীফা ও প্রদেশে গভর্ণর জনগণের মাঝে রেশন বিতরণের কার্যক্রম তদারক করতেন। গভর্ণরগণ বাজার অনুসন্ধান করতেন এবং দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি রোধে পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন। শুধু তাই নয় বিজিত অঞ্চলে বাড়িঘর বন্টনও প্রাদেশিক শাসনকর্তারা তত্ত্বাবধান করতেন।
১২. প্রশাসক ও কর্মচারী নিয়োগ:
‘উসমান রা.-এর আমলে রাজ্য বিজয়ের কারণে প্রদেশগুলোর সীমানা বেড়ে গিয়েছিলো। বিশেষত মিসর, সিরিয়া ও বসরা প্রদেশের আওতায় অনেক বিশাল এলাকা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। প্রাদেশিক রাজধানী শহরের বাইরেও অনেক শহর ও অঞ্চল রাজ্যগুলোর অধীনে শাসিত হত। খালীফা প্রাদেশিক গভর্ণর ও গুরুত্বপূর্ণ কর্মচারী নিয়োগ দিতেন। প্রদেশের অন্তর্গত বিভিন্ন শহর ও এলাকার প্রশাসক নিয়োগ দিতেন গভর্ণরগণ। তাছাড়া ছোটখাট বিভিন্ন পদে কর্মচারী নিয়োগের দায়িত্বও ছিলো প্রাদেশিক শাসনকর্তার।
১৩. জিম্মীদের হিফাযাত:
ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তাপ্রাপ্ত জিম্মীদের জান-মাল ও ইজ্জত-আব্রুর হিফাজত করা মুসলিম শাসকদের অন্যতম দায়িত্ব ছিল।
১৪. পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ:
উম্মাহর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ছিল রাসূলুল্লাহ সা.-এর সুন্নাহ । খুলাফা রাশিদূনও শীর্ষস্থানীয় সাহাবায়ে কিরামের পরামর্শে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। খালীফার অনুসরণে প্রাদেশিক গভর্ণরগণ স্থানীয় পর্যায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে জরুরী বিষয়গুলোতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন।
১৫. অবকাঠামোগত উন্নয়ন:
রাস্তাঘাট, পুল নির্মাণ ও সংস্কারসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নে গভর্ণরগণ দৃষ্টি দিতেন। সেচের জন্য খাল খনন, সুপেয় পানির ব্যবস্থা, কৃষি উন্নয়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, যাতায়াতের ব্যবস্থা উন্নতকরণ, মুসাফিরদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা, চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত, বাজার তৈরি ও নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয়ে গভর্নররা দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন