১৬ নভে, ২০২২

ইসলামী রাষ্ট্র ও সংবিধান

মাওলানা মওদূদীর লেখালেখির একটা বড় অংশ ছিল ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ঘিরে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাদা আলাদা লেখাগুলোকে একত্রিত করে একই মলাটে প্রকাশ করার দাবি ওঠে পাঠক মহল থেকে। জামায়াত নেতা ড. খুরশিদ আহমদ মাওলানার লেখাগুলোকে একত্র করে ইসলামী রিয়াসাত নামে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। এই বইটি বাংলায় 'ইসলামী রাষ্ট্র ও সংবিধান' নামে অনুবাদ হয়েছে।


ইসলামী জীবন ব্যবস্থার সকল দিক ও বিভাগ সম্পর্কে ইসলামী স্কলারগণ বিংশ শতাব্দীতে ব্যাপক আলোচনা করছেন। একদিকে তাঁরা কুরআন সুন্নাহ থেকে ইসলামের মূলনীতি পেশ করছেন, খুলাফায়ে রাশেদীনের রাষ্ট্র পরিচালনার আদর্শ দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করছেন। অপরদিকে যুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা পর্যালোচনার মাধ্যমে আধুনিককালে ইসলামী মূলনীতি ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার উপযোগীতা, বাস্তবতা ও অকাট্যতার প্রমাণ পেশ করেছেন।

এই উভয় ক্ষেত্রেই সাইয়েদ মওদূদী অন্যদের চেয়ে অগ্রজ। একদিকে তিনি আধুনিক বিশ্বে ইসলামী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা। অপরদিকে কুরআন সুন্নাহর অগাধ পান্ডিত্য, ইসলামের ইতিহাসের নির্যাস, শানিত যুক্তি আর অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিভা দিয়ে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা এবং ইসলামী রাষ্ট্রের বাস্তবতা ও বাস্তব রূপরেখা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছেন।

প্রফেসর ডক্টর খুরশীদ আহমেদ প্রথমে সাইয়েদ মওদূদীর এ সংক্রান্ত লেখাগুলোর ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশ করেন Islamic Law and Constitution’ নামে। ইংরেজি গ্রন্থটি সারাবিশ্বে অভূতপূর্ব সাড়া জাগায়। তখন প্রবলভাবে দাবি উঠতে থাকে ইংরেজি সংস্কারণের পাশাপাশি সাইয়েদ মওদূদী ইসলামী রাষ্ট্র সংক্রান্ত সমস্ত লেখা একত্রে সংকলিত করে মূল উর্দু ভাষায় একটি গ্রন্থ প্রকাশ করা হোক। সেই দাবি ও চাহিদার প্রেক্ষিতেই প্রফেসর খুরশীদ আহমদ ইসলামী রাষ্ট্র সংক্রান্ত তাঁর সমস্ত লেখা একত্রে করে ইসলামী রিয়াসাত গ্রন্থ তৈরি করেন ১৯৬০ সালে। ইংরেজি Islamic Law and Constitution গ্রন্থটি ৪১২ পৃষ্ঠা আর উর্দু ইসলামী রিয়াসাত গ্রন্থটি ৭২০ পৃষ্ঠা। দুটি গ্রন্থই বিশ্বব্যাপী দারূণভাবে সমাদৃত হয়েছে।

সঙ্গত কারণেই এই অসাধারণ সংকলনটি বাংলায় অনুবাদ হওয়ার দাবি ওঠে। অনুবাদ কর্ম আগে শেষ হলেও বইটি ১ম প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে। বইটি অনুবাদ করেন ৪ জন। আবদুস শহীদ নাসিম, আকরাম ফারুক, আব্দুল মান্নান তালিব ও মুহাম্মদ মুসা। বইটির টোটাল আলোচনাকে ১৬ টি অধ্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। এই ১৬ অধ্যায়কে আবার ৪ খন্ডে ভাগ করা হয়েছে।

১ম পাঁচ অধ্যায় নিয়ে ১ম খন্ড। ১ম খন্ডের নাম 'ইসলামের রাজনৈতিক দর্শন'। এই খন্ডে ইসলামের রাজনৈতিক থিওরি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

১ম অধ্যায়ে ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ধর্ম সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী? ইসলাম কী আচার সর্বস্ব কোনো ধর্ম? নাকি এটি জীবন সংশ্লিষ্ট বিধানের নাম? ইসলামী রাষ্ট্রের কেন প্রয়োজন? রাষ্ট্র ইসলামী না হলে ইসলামকে পূর্ণভাবে মানা যায় না। ইসলামের সকল বিধান মানার জন্য অবশ্যই রাষ্ট্রশক্তি প্রয়োজন। এই অধ্যায়ে আরো আলোচিত হয় ধর্ম নিরপেক্ষ মতবাদ নিয়ে। ইসলাম ও রাজনীতিকে আলাদা করার চিন্তা বাতিল মতবাদ এই নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে।

২য় অধ্যায়ে ইসলামের রাজনৈতিক মতাদর্শ কেমন তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ইসলামী রাজনীতির উৎস কী? তা দিয়েই এই অধ্যায়ের আলোচনা শুরু হয়েছে। নবীদের মিশন ও দায়িত্ব কী ছিল? ইসলামী রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও ধরণ নিয়ে আলোচনা হয়েছে এখানে। খিলাফত কী এবং এর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কী তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে।

৩য় অধ্যায়ে কুরআনের রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই অধ্যায়ে রাজনীতির মৌলিক থিওরি, জীবন সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভংগি, দীন এবং আল্লাহর আইন, রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব, সার্বভৌমত্ব ও খিলাফতের ধারণা এবং আনুগত্যের মূলনীতি এসব বিষয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে।

৪র্থ অধ্যায়ে খিলাফতের তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ আমাদের কী দায়িত্ব দিয়ে দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন তা সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে।

৫ম অধ্যায়ে মাওলানা মওদূদী ইসলামী জাতীয়তার ধারণা ও ইসলামী জাতীয়তার প্রকৃত তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। জাতীয়তার বিভিন্ন উপাদান ও জাহেলি সমাজে জাতিগত বিদ্বেষের কদর্য রূপ তুলে ধরা হয়েছে। এর বিপরীতে ইসলামের প্রশস্ত ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেওয়া হয়েছে।

৬ষ্ঠ থেকে ১১শ অধ্যায় নিয়ে ২য় খন্ড গঠিত হয়েছে। ২য় খন্ডের নাম ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলনীতি ও কর্মপন্থা।

৬ষ্ঠ অধ্যায়ে ইসলামী সংবিধানে আইনের উৎস নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আইনের উৎস হিসেবে কুরআন মাজীদ, রাসূলূল্লাহ সা.-এর সুন্নাহ, খিলাফতে রাশেদার কার্যক্রম এবং উম্মাতের মুজতাহিদগণের সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা করেছে মাওলানা।

৭ম অধ্যায়ে মাওলানা একটি ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তিওসমূহ নিয়ে আলোচনা করেছেন। ইসলামী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব কার? রাষ্ট্রের কর্মসীমা কতটুকু ব্যপৃত? রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগের কর্মসীমা বা অধিক্ষেত্র এবং এগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক কী হতে পারে? রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী? সরকার কিভাবে গঠিত হবে? শাসকের গুণাবলী ও যোগ্যতা কী হওয়া উচিত? নাগরিকত্ব কী? নাগরিকদের অধিকার ও নাগরিকদের উপর রাষ্ট্রের অধিকার এসব বিষয় নিয়ে দারুণ আলোচনা হয়েছে এই অধ্যায়ে।

৮ম অধ্যায়ে ইসলামী সংবিধানের ভিত্তি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই অধ্যায়ে যা আলোচনা হয়েছে তা হলো- আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, রিসালাতের মর্যাদা, খিলাফতের ধারণা, পরামর্শের নীতিমালা, নির্বাচনের নীতিমালা, নারীদের দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ, রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য, শাসক ও তার আনুগত্যের নীতিমালা, মৌলিক অধিকার ও সামাজিক সুবিচার ও জনকল্যাণ।

৯ম অধ্যায়ে ইসলামী রাষ্ট্রের উদাহরণ পেশ করা হয়েছে। নববী যুগের ১০ বছর ও পরবর্তী খুলাফায়ে রাশেদার আমলের বর্ণনা, শাসনপদ্ধতি ও মৌলিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করেছেন মাওলানা মওদূদী।

১০ম অধ্যায়ে ইসলামের আইন শাস্ত্র নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ইসলামে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্র এবং তাতে ইজতিহাদের গুরুত্ব, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, মহানবী সা.-এর অনুসরণ, ইজতিহাদ ও ইজতিহাদের জন্য প্রয়োজনীয় গুণাবলী নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও আইন প্রণয়নে শূরা ও ইজমার ভূমিকা এবং ইসলামী ব্যবস্থায় বিতর্কিত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সঠিক পন্থা নিয়ে বক্তব্য রেখেছেন মাওলানা মওদূদী।

১১শ অধ্যায়ে রাষ্ট্রের বিভিন্ন দিক ও বিভাগ নিয়ে আলোচনা করেছেন মাওলানা মওদূদী রহ.। এছাড়াও খিলাফাত ও স্বৈরতন্ত্র, জাতীয় রাজনীতিতে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও অমুসলিমদের অধিকার নিয়ে এই অধ্যায়ে আলোচনা হয়েছে।

দ্বাদশ থেকে পঞ্চদশ অধ্যায় পর্যন্ত ৩য় খন্ড। এই খন্ডের নাম ইসলামী শাসনের মূলনীতি।

১২শ অধ্যায়ে মাওলানা মৌলিক মানবাধিকার নিয়ে কথা বলেছেন। এই অধ্যায়ে মাওলানা মানবাধিকার কী? কবে থেকে এবং কেন এর উতপত্তি তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। সবশেষে ইসলাম মানুষকে যেসব অধিকার দান করেছে তা নিয়ে আলোচনা করেছেন।

১৩শ অধ্যায়ে মাওলানা অমুসলিমদের অধিকার নিয়ে বক্তব্য রেখেছেন। এই অধ্যায়ে মাওলানা একটি ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার কী হতে পারে তা নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। এর পাশাপাশি যেসব বিষয়ে তাদের হক বা অধিকার নেই তাও বিবৃত করেছেন।

১৪শ অধ্যায়ে ইসলাম ও সামাজিক সুবিচার নিয়ে আলোচনা করেছে মাওলানা মওদূদী। মাওলানা এখানে তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। ইসলামের সুবিচার ও সাম্যতার পাশাপাশি অন্যান্য মতবাদের শোষণনীতি ও তাদের অসারতা প্রমাণ করেছেন।

১৫শ অধ্যায়ে কুরআনের আলোকে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান নীতিমালাগুলো কী হওয়া উচিত তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এখানে মাওলানা রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য, ইসলামী রাষ্ট্রের প্রকৃতি, পরামর্শ বা শূরা, আদল ও ইহসান, নেতৃত্ব নির্বাচনের মূলনীতি, প্রতিরক্ষা এবং যুদ্ধ ও সন্ধির মূলনীতি, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং শিক্ষানীতির সাধরণ মূলনীতি, নাগরিকত্ব ও পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

ষোড়শ অধ্যায় নিয়ে ৪র্থ খন্ড গঠিত হয়েছে। এই খন্ডের নাম ইসলামী বিপ্লবের পদ্ধতি

১৬শ অধ্যায়ে মূলত একটি ইসলামী রাষ্ট্র কীভাবে গঠিত হবে তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। মাওলানা মওদূদী ৮ টি পয়েন্টে এই অধ্যায় লিখেছেন।
১. ইসলামী বিপ্লবের পদ্ধতি
২. ইসলামী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট
৩. ইসলামী বিপ্লবের পথ
৪. ইসলামী আন্দোলনের সঠিক কর্মপন্থা
৫.শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের পন্থা
৬. আধুনিক রাষ্ট্রে ইসলামী আন্দোলনের কর্মপন্থা
৭. ইসলামী রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠার সঠিক কর্মধারা
৮. রাজনৈতিক বিপ্লব আগে না সমাজ বিপ্লব?

'ইসলামী রাষ্ট্র ও সংবিধান' এই বইটি সকল মুসলিম বিশেষভাবে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের অতীব জরুরি পাঠ্যবই। এই বই অধ্যয়নের মাধ্যমে একজন পাঠক সহজেই ইসলামী রাষ্ট্র ও সংবিধানের রূপ ও প্রকৃতি কীরূপ হওয়া উচিত তা জানতে পারবে। ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য কর্মপন্থা কী হবে? এবং ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য নিজেকে কী দায়িত্ব পালন করতে হবে তার সঠিক নির্দেশনা পাবে।

মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের ইকামাতে দ্বীন তথা ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

#বুক_রিভিউ
বই : ইসলামী রাষ্ট্র ও সংবিধান
লেখক : সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী
অনুবাদক : আবদুস শহীদ নাসিম, আকরাম ফারুক, আব্দুল মান্নান তালিব ও মুহাম্মদ মুসা।
প্রকাশনী : শতাব্দি প্রকাশনী
পৃষ্ঠা : ৪৯৬
মুদ্রিত মূল্য : ২৫০
জনরা : থিয়োলজি ও রাজনীতি

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন