একদিন বিশিষ্ট সাহাবী হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান রা. বিচলিত হয়ে উসমান রা.-এর কাছে এলেন। তিনি বললেন, ইহুদী ও খৃস্টানদের মতো নিজেদের কিতাবের ব্যাপারে মতভেদ করার পূর্বেই আপনি এই উম্মাহকে সামলান। হুযাইফা রা. সিরিয় ও ইরাকী যোদ্ধাদের সাথে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। নানা অঞ্চলের মানুষের কুরআন পাঠের ভিন্নতা দেখে তিনি শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। তিনি পর্যবেক্ষণ করলেন, কেউ ইবনু মাস'উদ রা.-এর অনুসরণে কুরআন তিলাওয়াত করে। আবার অন্যরা আবূ মূসা আল-আশ'আরীর অনুসরণে কুরআন তিলাওয়াত করে। শুধু তাই নয়, এক দল অন্য দলকে হেয়জ্ঞান করে।
এই অবস্থা দেখে তিনি বললেন, 'কূফাবাসী বলে, ইবনু মাসউদের কিরাআত ভালো, বসরাবাসী বলে আবূ মূসার কিরাআত ভালো। আল্লাহর শপথ! আমি আমীরুল মু'মিনীনের কাছে গিয়ে অনুরোধ করবো তিনি যেন সবাইকে একই পঠনপদ্ধতির ওপর একত্রিত করেন। অভিযান শেষে মাদীনায় এসে হুযাইফা রা. উসমান রা.-কে বললেন, 'আমীরুল মু'মিনীন! ইয়াহুদী ও নাসারাদের মত নিজেদের কিতাবের ব্যাপারে মতভেদ করার পূর্বেই আপনি এই উম্মাহকে সামলান।
পঠনপদ্ধতির ভিন্নতার কারণে বিভিন্ন ক্বারির ছাত্রদের মাঝে বিতর্কের বিষয়টি উসমান রা. মদিনায়ও প্রত্যক্ষ করেছিলেন। একবার তিনি মসজিদে খুতবা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, 'তোমরা আমার সামনেই মতভেদ করো! না জানি দূরে যারা আছে তারা কী করে?
কুরআন সংকলনের বিষয়ে সাহাবীদের সাথে উসমান রা.-এর পরামর্শ করা শুরু করলেন। হুযাইফা রা.-এর আশংকা ও পরামর্শ উসমান রা. অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিলেন। করণীয় নির্ধারণে তিনি মুহাজির ও আনসারী সাহাবীগণকে একত্রিত করলেন। উম্মাহর শ্রেষ্ঠ আলিম, ফকীহ ও বিজ্ঞ ব্যক্তি এদের মধ্যেই ছিলেন। যাদের শীর্ষে ছিলেন আলী ইবনু আবি তালিব রা.। তাঁরা দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা পর্যালোচনা শেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, এই অবস্থা দীর্ঘায়িত হতে দেওয়া যায় না, মুমিনদের অন্তরে কোনো প্রকার সন্দেহ-সংশয় যেন প্রবেশ না করতে পারে।
তাই তাঁরা আবু বকর রা.-এর আমলে প্রস্তুতকৃত কুরআনের সংরক্ষিত কপি হতে আরো কয়েক কপি প্রস্তুত করে কুরআনের বিশুদ্ধ কপি ইসলামী খিলাফাতের নানা স্থানে প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই সংরক্ষিত কপি উম্মুল মুমিনিন হাফসা রা.-এর নিকট সংরক্ষিত ছিল। সিদ্ধান্ত অনুসারে খলীফা উসমান রা. হাফসা রা.-এর কাছে দূত পাঠিয়ে বললেন, 'আমাকে সংরক্ষিত কুরআনের সংরক্ষিত কপি পাঠিয়ে দিন। আমি কয়েকটি অনুলিপি তৈরী করে মূল কপি আপনার কাছে ফেরত পাঠাবো। হাফসা রা. তাঁর কাছে রক্ষিত আল কুরআন উসমান রা.-এর কাছে পাঠিয়ে দেন।
এরপর উসমান রা. চার সদস্যের একটি কমিটি তৈরি করেন। যার সদস্যরা ছিলেন, যায়িদ ইবনু সাবিত রা., আবদুল্লাহ ইবনু যুবাইর রা., সাঈদ ইবনুল আস রা. ও আবদুর রহমান ইবনুল হারিস রা.। তাদেরকে উসমান রা. আবু বকর রা.-এর আমলে প্রস্তুত কুরআনের সংরক্ষিত কপির অনুলিপি প্রস্তুত করার নির্দেশ দিলেন। এদের মধ্যে যায়িদ ইবনু সাবিত রা. ছিলেন মদিনার সাহাবী আর বাকীরা ছিলেন মক্কার। উসমান রা. কমিটির সদস্যদের জানালেন কোনো শব্দের আরবীত্বের ব্যাপারে যায়িদ ইবনু সাবিত রা.-এর সাথে বাকীদের মতভেদ হয় তবে তোমরা তা মক্কার ভাষায় লিপিবদ্ধ করবে। কারণ এই কিতাব কুরাইশদের ভাষায় নাযিল হয়েছে।
২৫ হিজরীতে কমিটির সদস্যরা কাজ শুরু করেন। চার সদস্যের কমিটির সবাই হাফিযুল কুরআন হলেও তারা হাফসা রা.-এর কাছ থেকে আনীত সাহীফাগুলোর ওপর ভিত্তি করে কুরআনের কয়েকটি অনুলিপি প্রস্তুত করলেন। উসমান রা. কয়েকটি শব্দের আরবীত্বের ব্যাপারে মতভেদের আশঙ্কা করেছিলেন। তবে একটি মাত্র শব্দ নিয়ে যায়িদ রা. ও কুরাইশী সংকলকদের মাঝে মতভেদ হয়েছিলো বলে জানা যায়। শব্দটি হল তাবূত। মদীনার আনসারদের উপভাষায় এটির পাঠ ছিল তাবুহ। এ বিষয়ে উসমান রা.-এর কাছে নির্দেশনা চাওয়া হলে তিনি তাবূত লিখতে বলেন।
উসমান রা.-এর আমলে সংকলিত আল কুরআনে আয়াত বা সূরার ধারাবাহিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে কোনরূপ পরিবর্তন আনা হয়নি। আবূ বাকর রা.-এর সংকলনে যে ধারাবাহিকতা ছিল সেটিই হুবহু বহাল ছিল উসমান রা.-এর সংকলনে। তাছাড়া কোন শব্দে কোনরূপ পরিবর্তন আনা হয়নি, সেটি সম্ভবও ছিল না। কুরআন সংকলনকালে আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর রা., উসমান রা.-কে বলেছিলেন, সুরা আল বাকারার ২৪০ নং আয়াতটি তো অন্য আয়াত দ্বারা (একই সূরার ২৩৪ নং আয়াত দ্বারা) মানসুখ হয়ে গেছে, তবে কেন আপনি সেটি বহাল রাখছেন?
জবাবে উসমান রা. বললেন, ভাতিজা, আমি (আল কুরআনের) কোন কিছু স্থান হতে পরিবর্তন করতে পারি না। খলীফার এই জবাব হতে বুঝা যায়, কোন আয়াত বাদ দেয়া তো দূরের কথা, কোন আয়াতের স্থান পর্যন্ত পরিবর্তন করা হয়নি। মৃত্যুর পূর্বে রা.-এর সামনে জিবরাঈল আ. পুরো কুরআন উপস্থাপন করেছিলেন। আবু বাকর রা.-এর সংকলনটি সেই উপস্থাপনার অনুরূপ, আবার উসমান রা.-এর সংকলনটি ছিল আবু বাকর রা.-এর সংকলনের অনুরূপ। এখানে কোনরূপ পরিবর্তন পরিবর্ধনের কোন ক্ষমতা কারো ছিল না।
বইয়ের মতো করে এই প্রথম কুরআন সংকলন হলো ৪ জনের কমিটির অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে। গ্রন্থাকারে কুরআনের অনুলিপি তৈরির কাজ সম্পন্ন হলে উসমান রা. মূল কপির পৃষ্ঠাগুলো হাফসা রা.-এর কাছে ফেরত পাঠালেন এবং অনুলিপিকৃত কুরআনের এক একটি কপি দূরবর্তী অঞ্চলগুলোতে প্রেরণ করলেন। এই কপিগুলোতে হারাকাত বা স্বরচিহ্ন এবং নুক্তা ছিল না। ফলে কুরআনের শব্দগুলো বিভিন্নভাবে তিলাওয়াত করার সুযোগ ছিল। এ কারণে উসমান রা. কুরআনের অনুলিপি প্রেরণের পাশাপাশি ক্বারীও প্রেরণ করেন। যাতে তারা জনগণকে একই পদ্ধতির ক্বিরাতের প্রশিক্ষণ দিতে পারেন।
আবদুল্লাহ ইবনু সাইব রা.-কে মক্কায়, আল-মুগীরা ইবনু শিহাবকে সিরিয়ায়, আবু আবদুল্লাহ আস-সুলামীকে কুফায়, আমির ইবনু কায়সকে বসরায় প্রেরণ করা হয়। যায়িদ ইবনু সাবিত রা.-কে মদীনার অধিবাসীদেরকে কিরাআত প্রশিক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হয়। উসমান রা. নিজের কাছে এক কপি রাখেন। শাহদাতের সময় তিনি সেই কপি পড়ছিলেন। সন্ত্রাসী মুনাফিক ঘাতকদের আঘাতে উসমান রা.-এর রক্তে ভিজে যায় কুরআনের সেই কপি।
কুরআনের সরকারি কপি নির্ধারণের পর বাকী খন্ড খন্ড যে কপিগুলো মদিনায় ছিল সেগুলোকে একত্র করা হলো। রাসূল সা.-এর কাছে যখন কুরআন নাজিল হতো তখন অনেক সাহাবী আয়াতগুলো লিখে রাখতেন ও এর ব্যাখ্যা-টিকা সংযোজন করে রাখতেন। সকল সাহাবী থেকে এসব কপি সংগ্রহ করা হয় যাতে কুরআন নিয়ে পরবর্তীতে সন্দেহ সংশয় না তৈরি হয়। কেউ হয়তো কুরআনের আয়াতের পাশে ব্যাখ্যামূলক কিছু শব্দ লিখে রেখেছেন। তাদের অবর্তমানে তাদের সন্তানরা ঐ শব্দকে কুরআনের শব্দ হিসেবে দাবি করে বসতে পারে। এই আশংকায় কুরআনের সব খন্ডাংশ ও নোট একত্র করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
কারো কুরআনের কপির প্রয়োজন হলে সে স্টান্ডার্ড/ আদর্শ কপি হতে অনুলিপি করার সুযোগ ছিল। উসমান রা. সকল গভর্নরকে নির্দেশ দিলেন মাদীনা হতে প্রেরিত মুসহাফ ব্যতীত কুরআনের অন্যান্য কপিগুলো যেন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে আল্লাহর কালাম পাঠে মতভেদ করা হতে মুসলিম উম্মাহ্ পরিত্রাণ লাভ করে। সাহাবায়ে কিরামের ঐকমত্যের ভিত্তিতে কুরআন সংকলনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তারা উসমান রা.-এর এই সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট ছিলেন। তারপরও কিছু কিছু স্থান থেকে এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা হয়।
সমালোচনাকারীদের উদ্দেশ্যে আলী রা. বলেন, ওহে জনগণ, উসমান রা.-এর ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করো না, তাঁর সম্পর্কে ভাল বৈ অন্য কিছু বলো না। আল্লাহর শপথ! কুরআন সংকলনের ব্যাপারে তিনি তো আমাদের সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আল্লাহর শপথ! আমি যদি দায়িত্বে থাকতাম তবে অনুরূপ সিদ্ধান্তই নিতাম।
কুরআন সংকলন নিয়ে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বিরোধীতা করেছেন বলে কিছু কিছু বর্ণনায় পাওয়া যায়। যদিও এসব নির্ভরযোগ্য বর্ণনা নয়। তবে সেসব বর্ণনায় এটাও উল্লেখ রয়েছে, পরে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. সাহাবাদের ইজমার সাথে ঐক্যমত পোষণ করেছেন। কুরআন সংরক্ষণের ব্যাপারে উসমান রা. ও তৎকালীন সাহাবাদের প্রচেষ্টা ছিল সত্যিই দূরদর্শী সিদ্ধান্ত। এর মাধ্যমে কুরআন সংরক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি একই স্টাইলে কুরআন পড়ার ব্যবস্থা হয়েছে। কুরআন নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ার পথ বন্ধ হয়েছে।
তৎকালে আরবি ভাষাভাষীরাও একই নিয়মে বা একই শব্দে আরবি বলতেন না। তাদের নিজেদের মধ্যেও উচ্চারণে পার্থক্য ছিল। উসমান রা.-এর প্রচেষ্টায় সারা পৃথিবীতে একই পদ্ধতিতে কুরআন পড়ার প্রচলন হয়। মূলত মক্কার লোকদের উচ্চারণেই কুরআন পড়া হয়। এর মাধ্যমে আরবি ভাষাতেও শৃঙ্খলা আসে। আরবের লোকেরা কুরআনের মাধ্যমে একটি স্টান্ডার্ড ভাষা পায়। শুধু তাই নয়, পরবর্তীতে কুরআনের ভাষার মান ভাষা হিসেবে নির্ধারণ আরবি ভাষার ব্যকরণ প্রস্তুত
হয়।
মহান রাব্বুল আলামীন ৩য় খলিফা উসমান রা. থেকে এই খেদমত নিয়ে তাঁকে সম্মানিত করেছেন। এই কারণে উসমান রা.-কে জামিউল কুরআন বলা হয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন