আজ ১৮ ডিসেম্বর। শহীদ মুস্তফা শওকত ইমরান ভাইয়ের শাহদাতবার্ষিকী।
১৯৭১ সালের এই দিনে তিনি শাহদাতবরণ করেন। মহান রাব্বুল আলামীন জানিয়েছেন তিনি শহীদদের জীবিত রাখেন ও রিজিক দেন। আজ এত বছর পর আমরা তাঁকে স্মরণ করছি যখন তাঁর অনুসারী অনুজরাই তাঁকে ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিল। অবশ্য তা বাধ্য হয়ে করেছিল। কিন্তু সেই ধারাবাহিকতায় কালক্রমে তা হারিয়ে যেতে বসেছে।
কিন্তু ঐ যে শহীদের রক্ত! এটা তো মুছা যাবে না। রক্ত কথা বলবেই!
মুস্তফা শওকত ইমরান ভাই ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র ছিলেন। বাড়ি ছিল তৎকালীন নোয়াখালীতে, বর্তমান ফেনীতে। ১৯৭১ সালে তিনি ইসলামী ছাত্রসংঘ, ঢাকা শহর শাখার সেক্রেটারি মনোনীত হন। সভাপতি নির্বাচিত হন শামসুল হক ভাই। ১৯৭১ সালের শেষ দিকে শামসুল হক হক ভাই নিখোঁজ হওয়াতে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন ইমরান ভাই।
৭১ সালের ডিসেম্বরে মুশরিকদের সহায়তায় তাদের এদেশীয় দালাল ও সমাজতন্ত্রীরা গণহত্যা শুরু করে। প্রথমেই আঘাত আসে চীনপন্থী সমাজতন্ত্রীদের ওপর যারা ভৌগলিক রাজনীতির কারণে পাকিস্তানের অখণ্ডতার পক্ষে ছিল। ১৪ ডিসেম্বর তাদের একটি বড় অংশকে খুন করা হয়।
এরপর আঘাত আসে ইসলামপন্থীদের ওপর। আর এর প্রধান শিকার হয় জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রসংঘ। ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে পল্টন ময়দানে নিয়ে আসা হয়। এর মধ্যে ছিলেন ঢাকা শহরের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মুস্তফা শওকত ইমরান ভাই।
১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের পল্টন গণহত্যার খুনীরা ইমরান ভাইকে দিয়ে তাদের রক্তখেকো চরিত্রের উন্মোচন করে। ইমরান ভাইকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। একইভাবে প্রায় তিনশত ইসলামপন্থী মানুষকে হত্যা করে। এর মধ্যে পঁচাত্তর জনের মতো ছিল জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা-কর্মী।
এই গণহত্যার মাস্টার মাইন্ড ছিল ক্র্যাক প্লাটুন। ক্র্যাক প্লাটুন তৈরি হয় খালেদ মোশাররফ ও এটিএম হায়দারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। এই বাহিনীর সদস্যরা ভারতের মেলাঘর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগ নেতা মায়া, বিচ্চু জালাল, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, গোলাম দস্তগীর গাজীসহ ৩৪ জন ছিল এই ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য। খালেদ মোশাররফ ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া তার সন্ত্রাসী বাহিনীকে দিয়ে ১৮ ডিসেম্বরের পল্টন গণহত্যা ঘটায়।
এই গণহত্যায় আরেকজনের নাম উল্লেখযোগ্য। সে হলো যুদ্ধাপরাধী কাদের সিদ্দিকী। সে ও তার অনুসারীরা ছিল বর্বর ও হিংস্র। তারা যুদ্ধের আগে ডাকাতি করতো। ক্র্যাক প্লাটুনের লোকদের গ্রেফতার করা শত শত নিরস্ত্র ও বেসামরিক মানুষকে হিংস্র ও বর্বরভাবে খুঁচিয়ে হত্যা করে কাদের সিদ্দিকী ও তার দল।
১৮ ডিসেম্বর সারাদেশে কয়েকশত জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতাকর্মীকে শহীদ করা হয়। একইসাথে নেজামে ইসলামী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ঢাকার অনেক মসজিদের ইমাম এবং অনেক কওমী মাদ্রাসায় হাজারো শহীদের রক্তের স্রোত বইয়ে দেওয়া হয়।
১৮ ডিসেম্বরে শহীদ ইমরান ভাইদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে ইতালির বিখ্যাত সাংবাদিক ওরিয়ানা ফ্যালাসি শেখ মুজিবের সাথে দীর্ঘ বাকযুদ্ধে লিপ্ত হন।
ফ্যালাসি ১৮ ডিসেম্বরের হত্যাকাণ্ডকে ম্যাসাকার হিসেবে উল্লেখ করে মুজিবের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে মুজিব বলে,
//- ম্যাসাকার? হোয়াট ম্যাসাকার?
- ঢাকা স্টেডিয়ামে মুক্তিদের দ্বারা সংঘটিত হত্যাকান্ডটি।
- ঢাকা স্টেডিয়ামে কোন ম্যাসাকার হয়নি, তুমি মিথ্যে বলছো।
- মিঃ প্রাইম মিনিস্টার। আমি মিথ্যাবাদী নই। সেখানে আরো সাংবাদিক ও হাজার হাজার লোকের সাথে আমি হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেছি। আপনি চাইলে ছবি দেখাতে পারি। আমার পত্রিকায় সে ছবি প্রকাশিত হয়েছে।
- মিথ্যেবাদী, ওরা মুক্তিবাহিনী নয়।
- মিঃ প্রাইম মিনিস্টার দয়া করে মিথ্যেবাদী শব্দটা আর উচ্চারণ করবেন না, তারা মুক্তিবাহিনী তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল আবদুল কাদের সিদ্দিকী।
- তাহলে হয়তো তারা রাজাকার ছিল, যারা প্রতিরোধের বিরোধীতা করেছিল এবং কাদের সিদ্দিকী তাদের নির্মূল করতে বাধ্য হয়েছিলো।
- মিঃ প্রাইম মিনিস্টার, কেউ প্রমাণ করেনি যে, লোকগুলো রাজাকার ছিল এবং বিরোধীতা করেছিল। তারা ভীতসন্ত্রস্ত্র ছিল, হাত-পা বাঁধা ছিল তারা নড়া ছড়াও করতে পারছিলোনা।
-মিথ্যেবাদী
- শেষবারের মত বলছি, আমাকে “মিথ্যাবাদী” বলার অনুমতি আপনাকে দেবো না।
- আচ্ছা সে অবস্থায় তুমি কি করতে?
- আমি নিশ্চিত হতাম, ওরা রাজাকার এবং অপরাধী, তারপর ফায়ারিং স্কোয়াডে দিতাম এবং খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এভাবে ঘৃন্য হত্যাকাণ্ড এড়াতাম।
- ওরা এভাবে করেনি, হয়তো আমার লোকেদের কাছে বুলেট ছিলনা।
- হ্যা তাদের কাছে বুলেট ছিল। প্রচুর বুলেট ছিল, এখনো তাদের কাছে প্রচুর বুলেট রয়েছে। তা দিয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত গুলি ছোঁড়ে। ওরা গাছে, মেঘে, আকাশে, মানুষের প্রতি গুলি ছোঁড়ে শুধু আনন্দ করার জন্য।//
যতদূর জানতে পেরেছি অর্থাৎ পুরাতন লোকদের কাছ থেকে শুনেছি বেয়নেট দিয়ে ইমরান ভাইয়ের বুক চিরে হৃৎপিণ্ড বের করে সেই রক্তাক্ত হৃৎপিণ্ড নিয়ে উল্লাস করেছে গণহত্যাকারী, যুদ্ধাপরাধী বর্বর খালেদ মোশাররফের ক্র্যাক প্লাটুন ও কাদের সিদ্দিকীর ডাকাত দল।
সেই ক্র্যাক প্লাটুনের গাজী দস্তগীর এখনো খুন করে যাচ্ছে। যতদূর জানা যায় গাজী দস্তগীরের সর্বশেষ শিকার ফারদিন নামের এক সাধারণ বুয়েট শিক্ষার্থী।
আল্লাহ তায়ালা শহীদ মুস্তফা ইমরান ভাইকে দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত করুন। সেই সাথে তাঁর সাথে শহীদ হওয়া হাজারো মুসলিমের রক্তের অভিশাপ থেকে আমাদের মুক্ত করুন। আমরা যাতে মুশরিকদের ফাঁদ থেকে উদ্ধার হতে পারি সেই তাওফিক দান করুন।
আল্লাহ তায়ালা শহীদের রক্তের সাথে গাদ্দারির মতো ভয়ংকর অপরাধ থেকে মুক্ত করুন। আমাদের ক্ষমা করুন। আস্তাগফিরুল্লাহ! আস্তাগফিরুল্লাহ!
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন