২১ ডিসে, ২০২২

খিলাফত পর্ব-৪০ : উসমান রা.-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ


উসমান রা.-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূত্রপাত কুফায়। কুফার একটি মহল উমার রা.-এর সময় থেকেই বিশৃঙ্খলা করতো। নানানভাবে তারা গভর্নরকে বিতর্কিত করতো। এর ফলে সেখানে রাষ্ট্র পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। বার বার তারা জনগণকে গভর্নরের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতো। জনগণ ঐ মহলের উস্কানিতে গভর্নর পরিবর্তনের দাবি জানাতো। উমার রা.-এর সময়ে তারা শুধু গভর্নরের দোষ খুঁজে পরিবর্তনের কথা বলা হতো। কিন্তু উসমান রা.-এর নরম স্বভাবকে কাজে লাগিয়ে তারা এবার তাদের পছন্দমতো ব্যক্তিকে গভর্নর বানানোর দাবি জানাতে থাকলো।

উমার রা.-এর শাহদাতের সময় কুফার গভর্নর ছিলেন মুগিরা বিন শুবা রা.। মুগিরা বিন শুবা রা.-কে তিনি নিয়োগ দিতে বাধ্য হন। কারণ মুগিরা রা. ছিলেন কঠোর প্রকৃতির মানুষ। কুফার ঐ প্রভাবশালী মহলকে কন্ট্রোল করার জন্য তিনি মজলিসে শুরায় দীর্ঘ আলোচনা করে মুগিরা রা.-কে গভর্নর নিয়োগ করেন। উমার রা. শাহদাতকালে অসিয়ত করেন কুফায় যেন পুনরায় সা'দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা.-কে গভর্নর করা হয়। সা'দ ছিলেন কুফা নগরীর প্রতিষ্ঠাতা। অসিয়ত অনুসারে উসমান রা. তাঁকে গভর্নর নিয়োগ করলেন। তবে তিনি সেখানে দ্বৈত-শাসন চালু করলেন। সা'দ রা.-কে সেনাবাহিনী প্রধান ও ইমামতির দায়িত্ব দিলেন। আর আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-কে দিলেন বাইতুল মাল বা রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব।

কুফায় গভর্ণর সা'দ রা.-এর কার্যকাল দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কুফার প্রভাবশালী লোকদের অভিযোগ আসতে লাগলে সা'দ রা.-এর বিরুদ্ধে। এর মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর সাথে বাইতুল মাল থেকে ঋণ নেওয়া নিয়ে মতবিরোধ তৈরি হয়। প্রভাবশালী মহল এটাকে পুঁজি করে আন্দোলন শুরু করে। ফলে সা'দ রা. অপসারিত হন। সা'দ রা.-কে অপসারণের পর আল-ওয়ালীদ ইবনু উকবাকে কুফার গভর্ণর পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি আবু বাকর রা.-এর আমলে বাহিনী প্রধান হিসেবে জর্দানে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। উমার রা. তাঁকে আরব আল-জাযীরায় যাকাত ও রাজস্ব আদায়ের কাজে নিযুক্ত করেছিলেন।

আল ওয়ালিদের বিরুদ্ধে মদ্যপানের অভিযোগ আসলে (এটাও একটা অসত্য অভিযোগ ছিল) তাকে অপসারণ করে সাঈদ ইবনুল আস রা.-কে কুফার গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। কুফাবাসী বার বার শাসকদের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনতে লাগলো। তারা এবার সাঈদ অবনুল আসের বিরুদ্ধে অনাস্থা এনে আবু মুসা আল-আশ'আরী রা.-কে নিয়োগ দেয়ার জন্য দাবী করলো খলিফার কাছে। খলিফা উসমান রা. তাদের এই দাবিও পূরণ করেন। কুফায় আবু মুসা আল-আশ'আরী রা.-কে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেন। তবে এবার উসমান রা. বিশৃঙ্খলাকারীদের চিহ্নিত করে কুফা থেকে সিরিয়ায় বহিষ্কার করেন এবং মুয়াবিয়া রা.-কে তাদের নসিহত করার নির্দেশ দেন।

মুয়াবিয়া রা.-এর নসিহত তারা শুনেননি। মুয়াবিয়া রা. তাদের আচরণে অতিষ্ঠ ছিলেন। মুয়াবিয়া রা. তাদের আবার কুফায় ফেরত পাঠানোর আবেদন জানালেন। এবার ঐ প্রভাবশালী মহল আর কুফার গভর্নরের বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধ থাকে নি। এবার তারা উসমান রা.-এর বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ এনে জনগণকে ক্ষিপ্ত করার চেষ্টায় ছিল। তাদেরকে এই কাজে সহায়তা করেছে ইয়েমেনের ইহুদি আব্দুল্লাহ বিন সা'বা। কুফায় অনেকে উসমান রা.-এর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে নানাবিধ মিথ্যা অপবাদ দিলে লাগলো। এই পরিস্থিতিতে আবু মুসা আল-আশ'আরী রা. তাদের সমস্ত মিথ্যা অভিযোগের জবাব দেন এবং আগামীতে এই ধরণের কাজ করলে তাদেরকে বিশৃঙ্খলা ও মিথ্যা অপবাদের শাস্তি দেয়ার হুমকি দেন।

উসমান রা. এবার তাদের হোমসে নির্বাসনে পাঠান। সেখানের শাসক ছিলেন আব্দুর রহমান ইবনে খালিদ। আব্দুর রহমান তাদের সাথে খুবই কঠোর আচরণ করলেন। তাদেরকে তিনি বললেন, আমাকে সাঈদ ও মুয়াবিয়ার মতো মনে করলে ভুল করবে। আমি শয়তানের ঘুঁটিদের মাথা উড়িয়ে দিতে জানি। আমি খালিদ বিন ওয়ালিদের ছেলে। ফিতনাবাজেরা হোমসে দশ মাসের মতো ছিল। আব্দুর রহমানের কঠোর শাসনে তারা সবাই সংশোধন হলো। নিজেদের অপকর্মের জন্য ক্ষমা চাইলো। উসমান রা. তাদের আবার যেখানে ইচ্ছা সেখানে বসবাস করার অনুমতি দিলেন। অবাক করা ব্যাপার হলো তাদের অধিকাংশই আব্দুর রহমানের সাথে থাকতে পছন্দ করলো।

কুফার সমস্যা মিটলেও শুরু হয়েছিল মিসরে সমস্যা। তার কারণ ছিল, হযরত উসমান ইব্‌ন আফফান রা. কর্তৃক আমর ইবনুল আস রা.-কে মিসর থেকে প্রত্যাহার করা এবং আবদুল্লাহ ইব্‌ন সা'দ কে আমীর নিযুক্ত করা। মিসরের একদল মুসলিম ইসলামী শাসনের বিরুদ্ধে সবসময় কথা বলতো। এটা উমার রা.-এর সময় থেকেই ছিল। আমর ইবনুল আস রা.-এর শাসনে তারা পরাভূত ছিল। তাই তারা খলীফার ও আমীরের বিরুদ্ধে কোন রকম বিরূপ মন্তব্য করতে সাহস পেত না। তারা এরূপ অবস্থায় দিন কাটাতে লাগল। একদিন তারা হযরত উসমান রা.-এর কাছে আমীরের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করল এবং তাকে তাদের থেকে প্রত্যাহার করে অন্য একজন তার চেয়ে নম্র শাসক নিযুক্ত করার দাবি জানাল। তাদের এ দাবি আদায়ের জন্য তারা খলীফার উপরে চাপ সৃষ্টি করতে লাগল। তারপর খলীফা আমর রা.-কে সেনাপতির পদ থেকে প্রত্যাহার করলেন কিন্তু তাকে সালাতের ইমামতিতে বহাল রাখলেন। সেনাপতি ও কর আদায়ের দায়িত্ব দিলেন আবদুল্লাহ ইব্‌ন সা'দকে।

এরপর কুচক্রীরা আমর রা. ও আব্দুল্লাহ ইবনে সা'দের সাথে ঝামেলা তৈরি করলো। আব্দুল্লাহ ইবনে সা'দ সুদানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে আমর রা.-এর সাথে মতবিরোধ তৈরি হলো। আমর রা. এর আগে কয়েকবার এই অভিযানে ব্যর্থ হন। যদিও তিনি রোমানদের বিরুদ্ধে বড় জয় লাভ করেছিলেন। কিন্তু তিনি আফ্রিকায় ব্যর্থ হন। উসমান রা. আমর ইবনুল আস রা.-কে মদিনায় নিয়ে আসেন ও উপদেষ্টা নিয়োগ করেন। আর মিসরের গভর্নর হিসেবে আব্দুল্লাহ ইবনে সা'দকে নিযুক্ত করেন। স্বাভাবিকভাবেই আমর রা. এই বিষয়টা পছন্দ করেননি।

আমর রা. মদিনায় ফিরে গেলে আমর রা.-এর অনুসারীরা বিষয়টাকে খুবই খারাপ চোখে দেখলো। তারা উসমান রা.-এর বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির (আব্দুল্লাহ বিন সা'দ উসমান রা.-এর আত্মীয়) অভিযোগ আনলেন। যদিও আব্দুল্লাহ বিন সা'দ শুরু থেকেই অর্থাৎ উমার রা.-এর আমল থেকেই আমর রা.-এর ডেপুটি হিসেবে কাজ করছিলেন। ফিলস্তিন, মিসর ও রোমানদের বিরুদ্ধে বড় জয়ে আব্দুল্লাহ বিন সা'দ আমর রা.-এর যোগ্য সহযোগী ছিলেন। আমর রা.-কে পছন্দ করা লোকেরা আব্দুল্লাহ বিন সা'দের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিমত করতে শুরু করলেন। একইসাথে তারা উসমান রা.-এর ওপরও ক্ষিপ্ত ছিল। তাদের মূল অভিযোগ উসমান রা. প্রবীণ সাহাবীদের বরখাস্ত করে তরুণদেরকে দায়িত্ব প্রদান এবং অযোগ্য আত্মীয়-স্বজনদের নিয়োগ প্রদান করা। এছাড়াও এর সাথে যুক্ত হয়েছে কুফার লোকদের করা অপপ্রচার। এখানেও ইহুদি আব্দুল্লাহ বিন সা'বা ইসলামী রাষ্ট্রে গোলযোগ লাগানোর জন্য প্ররোচনা দিতে লাগলো।

এই বিষয়ে উসমান রা.-এর সাথে কথা বলার জন্য কয়েকজন সাহাবীর সন্তানেরা মিসরে একত্রিত হন। এরা সবাই মিসর জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন মুহাম্মদ ইব্‌ন আবূ বকর রা.। তারা তাদের সাথে যাওয়ার জন্য প্রায় ছয়শত মানুষকে রাজি করাল। তারা চারটি দলে বিভক্ত ছিল এবং তাদের চারজন নেতাও ছিল। তারা হলো, আমর ইব্‌ন বুদাইল, আবদুর রহমান ইব্‌ন উদাইস, কিনানাহ ইবন বশর, সূদান ইব্‌ন হুমরান। তাদের সাথে সংগী ছিলেন মুহাম্মদ ইব্‌ন আবূ বকর রা.। এই বিষয়ে বিস্তারিত লিখে গভর্নর আব্দুল্লাহ বিন সা'দ দূত পাঠালেন উসমান রা.-এর কাছে। উসমান রা. এই বিষয়ে কথা বলার জন্য আলী রা.-এর নেতৃত্বে একদল প্রবীণ সাহাবীকে দায়িত্ব দিলেন।

আলী রা. তাদের সাথে কথা বললেন, তাদের অভিযোগ শুনলেন ও জবাব দিলেন। প্রকৃত তথ্য তাদের কাছে তুলে ধরলেন ও তাদেরকে সন্তুষ্ট চিত্তে ফেরত পাঠালেন। এরপর অভিযোগকারীরা লজ্জিত হলো এবং একে অন্যকে বলতে লাগল এ জন্যে কি তোমরা আমীরের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাও? মিসরের অভিযোগকারীরা ৫ টি অভিযোগ করেন।
১. সরকারী চারণ ভূমি নিজস্ব স্বার্থে ব্যবহার।
২. কুরআন শরীফ জ্বালিয়ে দেওয়া।
৩. মুসাফিরী অবস্থায় পূর্ণ নামায আদায় করা।
৪. প্রবীণ সাহাবীদেরকে বরখাস্ত করে তরুণদেরকে আমীর নিযুক্ত করা।
৫. বনু উমাইয়ার সদস্যদেরকে অধিক হারে চাকুরীতে নিয়োগ করা।

হযরত আলী রা. এসব অভিযোগের উত্তর প্রদান করেন।
১. সরকারের কিছু সম্পত্তি সীমানা নির্ধারণ করে পৃথক করা হয় খলিফার নিজের ভেড়া-বকরী চরাবার জন্যে নয় বরং তা করা হয়েছে বাইতুলমালের উট চরাবার জন্যে, যাতে এগুলো পূর্ণভাবে মোটাতাজা হতে পারে।
২. কুরআন শরীফের বিরোধপূর্ণ কিছু অংশ (কিরাতের বিভিন্নতা) সাহাবায়ে কিরামের সম্মতিতে পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণযোগ্য অংশগুলো বাকি রাখা হয়। কুরআন সংকলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে এরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিত হয়েছে।
৩. পবিত্র মক্কায় মুসাফিরী অবস্থায় পূর্ণ সালাত আদায় করার বিষয়টির ব্যাখ্যা হলো, তিনি পবিত্র মক্কায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং এখানে ১৫ দিনের অধিককাল থাকর নিয়ত করেন। তাই তিনি পূর্ণ নামায আদায় করতেন।
৪. তরুণদেরকে নিয়োগ দেওয়ার ব্যাপারে এই কথাই সত্য যে, তিনি ন্যায়পরায়ণ ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গকে নিয়োগ দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সা. ইতাব ইবন উসাইদ রা.-কে পবিত্র মক্কার আমীর নিযুক্ত করেছিলেন। অথচ তার বয়স ছিল তখন ২০ বছর মাত্র। অনুরূপভাবে উসামা ইবন যায়িদ ইবন হারিসা রা.কে রাসূলুল্লাহ সেনাপতি নিয়োগ করেন অথচ জনসাধারণ তাঁকে আমির নিযুক্ত করার ব্যাপারে আপত্তি উত্থাপন করে। তখন রাসূলুল্লাহ বলেন, “তিনি আমীর হওয়ার উপযুক্ত।
৫. তাঁর নিজ সম্প্রদায় বনু উমাইয়ার সদস্যদেরকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে বলা যায় যে, রাসূলুল্লাহও অনেক বিষয়ে কুরাইশকে অগ্রাধিকার দিতেন। উসমান রা. তার আত্মীয়দের হক ও অধিকারের ব্যাপারে অধিক সচেতন। তিনি অন্যায়ভাবে কিছু করেননি।

আলী রা. উসমান রা.-এর কাছে ফেরত আসেন এবং বিদ্রোহীদের ফিরে যাবার সংবাদ হযরত উসমান রা.-এর নিকট দিলেন। আর তারা যে হযরত আলী রা.-এর কথা শুনেছেন তাও ব্যক্ত করেন। তবে আলী রা. উসমান রা.-এর কাছে কিছু পর্যবেক্ষন দিলেন। তিনি সারা রাষ্ট্রে বিভিন্ন স্থানে প্রচারিত খবর ও মানুষের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানালেন। তিনি আশংকা করলেন, এভাবে চলতে থাকলে কয়েকদিনের মধ্যে কুফা ও বসরা থেকেও এমন অভিযোগে লোকজন আসতে পারে।

তিনি হযরত উসমান রা.-কে জনগণের কাছে একটি খুতবা দেওয়ার জন্যে অনুরোধ করলেন। এ খুতবার মাধ্যমে তিনি তার কিছু সংখ্যক আত্মীয়-স্বজনকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রেক্ষিতে যে অন্যায় হয়েছে তার সম্বন্ধে যেন জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং তাদেরকে এ কথার উপরে সাক্ষ্য দিতে বলেন যে, তিনি তা থেকে তাওবা করেছেন এবং তার পূর্বে দুইজন প্রবীণ খলীফা যেভাবে কাজ করেছেন তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখবেন। তিনি তা থেকে লক্ষ্যভ্রষ্ট হবেন না। আলী রা. উসমান রা.-কে এই পরামর্শ দিয়েছেন যাতে বিদ্রোহের আগুন প্রশমিত হয়।

এদিকে মদিনার মানুষের অভিযোগ ছিল মারওয়ান ইবনে হাকামকে নিয়ে। মারওয়ান ও তার পিতাকে আল্লাহর রাসূল সা. মদিনা থেকে তায়িফে নির্বাসন দিয়েছেন। উসমান রা. মারওয়ানকে মদিনায় এনে তাঁর উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব দেন। এতটুকু পর্যন্ত সমস্যা ছিল না। কিন্তু মারওয়ান ক্ষমতার দম্ভ দেখাত, প্রায়ই মদিনার বাসিন্দাদের শাসাত। এই নিয়ে মদিনাবাসী ক্ষুব্ধ ছিল। উসমান রা. তাদের সম্পর্কে বলেন, তিনি তাদেরকে তাদের মঙ্গলের জন্যই সমুচিত শাসন করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সা. তাদেরকে তায়িফে প্রথম নির্বাসন দিয়েছিলেন। তারপর তাকে ফেরত আসার অনুমতি দেন। তিনি এই বিষয়ে কয়েকজন সাহাবাকে সাক্ষী হিসেবে উল্লেখ করেন। তারাও সাক্ষ্য দেয়। তারপরও মদিনাবাসী মারওয়ানকে নিয়ে উসমান রা.-এর ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। আলী রা. সেদিকে ইঙ্গিত করে মদিনাবাসীর সামনে ভাষণ দেওয়া ও তওবা করার কথা বলেছেন যাতে রাজধানী অর্থাৎ মদিনা উসমান রা.-এর কন্ট্রোলে থাকে।

এটা স্পষ্ট ছিল যে, যখন মিসর থেকে একদল মুসলিম রণপ্রস্তুতি নিয়ে অভিযোগসহ আসলো তখন মদিনাবাসী উসমান রা.-এর পক্ষে সেভাবে রুখে দাঁড়ায়নি। অর্থাৎ মদিনাবাসীর মনেও অভিযোগ ছিল। উসমান রা.-এর কাছে কেউ আসলে আগে মারওয়ানের সাথে দেখা করতে হতো। সরাসরি খলিফার সাথে সাধারণত দেখা হতো না। এর আগে মদিনাবাসী উসমান রা.-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে তাঁকে সিদ্ধান্ত থেকে সরিয়ে এনেছিল। বহুদিন আফ্রিকা বিজয় করতে না পারায় উসমান রা. ঘোষণা দিলেন আব্দুল্লাহ বিন সা'দ যদি আফ্রিকা বিজয় করতে পারে তবে তাকে গনিমতের পাঁচ ভাগের এক ভাগ যা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হওয়ার কথা তা তাকে দেওয়া হবে। আফ্রিকা বিজয়ের পর উসমান রা. তাই করলেন। কিন্তু মদিনাবাসী এই সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করলেন। ফলে উসমান রা. তাঁর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে বাধ্য হলেন।

খলিফা উসমান রা. আলী রা.-এর এ পরামর্শটি শুনলেন এবং তা গ্রহণ করেন। জুমার দিন যখন আসল তিনি জনগণের মাঝে খুতবা দেন এবং খুতবার মধ্যে দুই হাত উত্তোলন করে বলেন, হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং আমি তোমার কাছে তাওবা করছি। হে আল্লাহ! আমার থেকে যা কিছু হয়ে গেছে আমি তার সর্বপ্রথম তাওবাকারী। তারপর দুইচোখের অশ্রু ছেড়ে দিলেন। সমস্ত মুসলমানও তাঁর সাথে কাঁদলো। মদিনার জনগণ তাদের ইমামের জন্য অত্যন্ত দরদ দেখালেন। হযরত উসমান রা. জনগণের এরূপ ব্যবহার স্বয়ং প্রত্যক্ষ করলেন। আর তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন আবূ বকর সিদ্দীক রা. ও হযরত উমার রা. যেভাবে চলেছিলেন তিনিও সেভাবে চলবেন। তিনি তার ঘরের দরজা সাক্ষাতপ্রার্থীদের জন্যে খোলা রাখবেন। কাউকে তিনি কোনো সময় বাধা দিবে না। তিনি মিম্বার থেকে নামলেন এবং জনগণকে নিয়ে সালাত আদায় করলেন। তারপর ঘরে প্রবেশ করলেন এবং আমীরুল মু'মিনীনের ঘরে কোন প্রয়োজন কিংবা মাসয়ালা কিংবা প্রশ্নের উত্তর জানার জন্যে যদি কেউ প্রবেশ করতে ইচ্ছে করেন তাহলে তাকে কোনরূপ বাধা দেওয়া হবে না।

এরপর উসমান রা. তার আত্মীয় স্বজন ও বংশধরদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হলেন। তারা মিসর থেকে আগমনকারী দলকে বিদ্রোহী হিসেবে উল্লেখ করে তাদের শাস্তি দেওয়ার কথা বললেন। একমাত্র খলিফার স্ত্রী নাইলা রা. বলেছেন আপনি সঠিক কাজ করেছেন। মদিনাবাসী আপনাকে এখন গভীরভাবে শ্রদ্ধা করবে।

মারওয়ান বললো, আমার পিতা-মাতা আপনার ওপর কুরবান হোক। আমি চেয়েছিলাম, আপনার কথাবর্তা হবে অত্যন্ত কঠোর, আর আপনি থাকবেন অটল ও অনড়। তাহলে আমি হতাম প্রথম ব্যক্তি যে এটাকে মেনে নিত এবং এটাকে সাহায্য-সহায়তা করত কিন্তু আপনি যা বললেন, তাতে অবস্থা অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করেছে। অনেক কিছু হাতছাড়া হয়ে গেছে। অসম্মানিত ব্যক্তিকে সম্মান দেওয়া হয়েছে। আপনি যদি চাইতেন তা হলে তাওবার দৃঢ় প্রত্যয় নিতে পারতেন এবং আমাদের কাছে কথিত অন্যায় অস্বীকার করতে পারতেন। আত্মীয়দের বিভিন্ন বাক্যবাণে উসমান রা. অস্থির হয়ে পড়লেন।

এর মধ্যে বহু মানুষ উসমান রা.-এর সাথে দেখা করার জন্য তার ঘরের সামনে জড়ো হলো। উসমান রা. বলেন, তুমি যাও এবং তাদের সাথে কথা বলো। তাদের কথা শোন। তাদের সাথে কথা বলতে আমার লজ্জা হচ্ছে।

সুযোগ পেয়ে মারওয়ান দরজার দিকে এগিয়ে আসলো। সে বললো,
“কি হয়েছে? তোমাদেরকে দেখে মনে হয় যেন তোমরা এখানে লুট করতে এসেছ! তোমাদের উপর অভিশাপ, প্রত্যেক মানুষ তার সাথীর উপকার করে থাকে তবে যার উদ্দেশ্য অসৎ তার কথা ভিন্ন। তোমরা এখানে এসেছ আমাদের ক্ষমতা হরণ করার জন্যে। অতএব তোমরা এখান থেকে বেরিয়ে পড়ো। আল্লাহর শপথ! আবার যদি তোমরা আমাদেরকে প্রভাবিত করতে চাও, তাহলে তোমাদের জন্যে এমন হুকুম জারি করা হবে, যা তোমাদের সকলকে কষ্ট দিবে। আর তোমরা তার পরিণাম প্রশংসার চোখে দেখবে না। তোমাদের ঘরে তোমরা ফিরে যাও। আল্লাহর শপথ! আমাদের হাতে যে ক্ষমতা আছে তা নিয়ে আমরা পরাভূত হবো না।

মদিনার জনগণ অপমানিত হয়ে কষ্ট পেয়ে ফিরে গেলেন। তাদের কয়েকজন হযরত আলী রা.-এর কাছে আগমন করলেন এবং পুরো ঘটনা জানালেন। আলী রা. অত্যন্ত রাগান্বিত হলেন এবং দ্রুত উসমান রা-এর ঘরে প্রবেশ করলেন। তিনি উসমান রা.-কে বললেন, আপনি কি মারওয়ানের প্রতি সন্তুষ্ট? কিন্তু আপনার দ্বীন ও বিবেক বুদ্ধি ধ্বংস না করা পর্যন্ত সে আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না। আপনার উদাহরণ এখন ভারবাহী উটের ন্যায়। আল্লাহর শপথ! মারওয়ান ধর্মের দিক দিয়েও সচেতন নয় এবং বিবেকের দিক দিয়েও বুদ্ধিমান নয়। আল্লাহর শপথ! আমি তাকে দেখেছি যে, সে আপনাকে রাস্তায় নামিয়ে দেবে আর উঠাতে পারবে না। এরপর আর আমি আপনার ব্যাপারে মাথা ঘামানোর জন্যে আপনার কাছে আসব না। একথা বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন।

আলী রা. বের হয়ে যাওয়ার পর হযরত উসমান রা. হতভম্ব হয়ে গেলেন। তাঁর স্ত্রী নাইলা রা. ঘরে প্রবেশ করলেন এবং বললেন, হযরত আলীর কথা আমি সব শুনেছি। তিনি আর আপনার কাছে আসবেন না। আপনি মারওয়ানের কথামত চলছেন। খলীফা বললেন, এখন আমি কি করব? নাইলা রা. বললেন, "আপনি শুধুমাত্র একচ্ছত্রভাবে আল্লাহকে ভয় করুন এবং আপনার পূর্ববর্তী দুই খলীফার নীতি অনুসরণ করুন। কেননা, আপনি যদি মারওয়ানের কথা শুনেন, তাহলে সে আপনাকে ধ্বংস করে দিবে। আপনি আলী রা.-এর কাছে লোক প্রেরণ করুন এবং তাঁর থেকে উপস্থিত সংকট কাটানোর জন্য পরামর্শ গ্রহণ করুন। কেননা, তিনি আপনার নিকটাত্মীয়। তিনি আপনার কথা আমান্য করবেন না।”


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন