২৪ জানু, ২০২৩

ঝিনাইদহ গণহত্যা : বাংলাদেশ পুলিশের ভয়ংকর রূপ ( পর্ব – ০১)

ঘটনার সূত্রপাত একজন ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান নাগরিক হত্যা নিয়ে। ঝিনাইদহে হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক সমির উদ্দিন মণ্ডল ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারে কাজ করছিলেন। কে বা কারা ২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি তার চেম্বারে রোগী সেজে তাকে হত্যা করে। ঘটনাটি ঘটে ঝিনাইদহ সদরের কালুহাটি গ্রামের বেলেখাল বাজারে। 

ওইদিন রাতেই মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) 'ধর্মান্তরিত হওয়ায়' সমিরকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে বলে খবর দেয় জঙ্গি হুমকি পর্যবেক্ষণকারী ওয়েবসাইট 'সাইট ইনটিলেজেন্স গ্রুপ'। সমির উদ্দিন ২০০১ সালে স্থানীয় 'ওয়ানওয়ে চার্চ বাংলাদেশ' এর মাধ্যমে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন বলে দাবি করেন চার্চের ঝিনাইদহ এলাকার কো-অর্ডিনেটর হারুন অর রশিদ। হারুন আরো বলেন, "সমির খ্রিস্টধর্ম প্রচারে নিয়োজিত ছিলেন। জঙ্গিরা এ কারণেই তাকে হত্যা করেছে।" 

বাংলাদেশের পুলিশ প্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে জোর গলায় আইএসের বিষয়টি অস্বীকার করা হয়। তারা তাদের এই কথাকে সত্য প্রমাণ করতে ভয়ংকর ষড়যন্ত্র শুরু করে। মুসলিম থেকে খ্রিস্টান হয়ে যাওয়া সমিরের খুনের দায় তারা জামায়াত-শিবিরের ওপর চাপানোর চেষ্টা করে। খুনীদের ধরার ব্যাপারে তাদের প্রচেষ্টা দেখা যায় না বরং তারা কীভাবে এর দায় জামায়াত-শিবিরের ওপরে চাপিয়ে দেবে সেই প্রচেষ্টা বেশ লক্ষ্যণীয়। 

বাংলাদেশ পুলিশ তাদের এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করার জন্য একে একে খুন করে ১৪ জন মানুষকে। ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে কয়েকজনকে সমির হত্যার স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করে। যে কয়েকজন স্বীকারোক্তি দিয়েছে তারা বেঁচে আছেন। যারা শত নির্যাতনেও স্বীকারোক্তি দিতে রাজি হয়নি তাদের খুন করে ফেলা হয়েছে। এই গণহত্যার মাস্টার মাইন্ড হলো, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তৎকালীন আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক। মাঠ পর্যায়ে এই গণহত্যা কার্যক্রম পরিচালনা করে ঝিনাইদহের তৎকালীন এএসপি আজবাহার আলী শেখ, সদর থানার ওসি হাসান হাফিজুর রহমান, হরিণাকুণ্ড থানার ওসি মাহাতাব উদ্দীন, মহেশপুর থানার ওসি আমিনুল ইসলাম, কালিগঞ্জ থানার ওসি আনোয়ার হোসেন ও ঝিনাইদহ ডিবি পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম এ হাসেম খান।   

গণহত্যার প্রথম শিকার জামায়াত কর্মী ও মাদ্রাসা শিক্ষক আবু হুরাইরা মালিথা। তাঁর বয়স ছিল ৫৫ বছর। ২০১৬ সালের ২৩ জানুয়ারি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার শৈলমারী বাজার সংলগ্ন কুঠিদুর্গাপুর দাখিল মাদ্রাসা থেকে আবু হুরাইরা মালিথাকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে সাদা পোশাকের লোকজন তুলে নিয়ে যায়। কুঠিদুর্গাপুর দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক আবু হুরাইরা সদর উপজেলার অশ্বস্থলী গ্রামের মৃত আশির উদ্দীন মালিথার ছেলে। মাদ্রাসা সুপার শরিফুল ইসলাম জানান, ঘটনার দিন (২৩ জানুয়ারি ‘১৬) সকাল ১০টার দিকে আবু হুরাইরা মাদ্রাসার ক্লাস নিচ্ছিলেন। এ সময় মটরসাইকেল যোগে কয়েকজন সাদা পোশাকের মানুষ এসে জানান, তারা বৃহত্তর যশোর থেকে এসেছেন এবং ডিবি পুলিশের লোক। ডিবি পুলিশের কথা শুনে শিক্ষক আবু হুরাইরা তাদের সঙ্গে চলে যান। 

ডিবি পরিচয়ে শিক্ষক আবু হুরাইরাকে নিয়ে যাওয়ার পর মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ও তার পরিবারের লোকজন এক মাসেরও বেশি সময় কোথাও তাকে খুজে পাচ্ছিলেন না। ঝিনাইদহ পুলিশ ও ডিবির পক্ষ থেকেও বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছে। এ ব্যাপারে ঝিনাইদহ গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম এ হাসেম খান জানিয়েছে, আবু হুরাইরা নামে তারা কাউকে আটক করেননি। আবু হুরাইরার পরিবার সদর থানায় জিডি করতে গেলে তা গ্রহণ না করে পরিবারকেই খোঁজ করতে বলেছে সদর থানার ওসি হাসান হাফিজুর রহমান। 

২৩ জানুয়ারী আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দিয়ে মাদরাসা থেকে তুলে নেয়ার ১ মাস ৬ দিন পর আবু হুরাইরা মালিথার  ক্ষত-বিক্ষত লাশ ২০১৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারী সোমবার যশোর চৌগাছা সড়কের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পাওয়া যায়। যশোর কতোয়ালি থানা পুলিশ অজ্ঞাত হিসেবে লাশটি উদ্ধার করে। সন্ধ্যায় যশোর হাসপাতাল মর্গে লাশটি আবু হুরাইরার বলে তার ভাই আব্দুল খালেক মাস্টার শনাক্ত করেন।  

ঝিনাইদহ পুলিশের ২য় শিকার হলেন ঝিনাইদহ আলীয়া মাদ্রাসার ফাজিলের ছাত্র ও শিবির নেতা হাফেজ জসিম উদ্দীন। তাঁর বয়স ২৫ বছর। জসিমের বাবা কালুহাটি গ্রামের খলিল মন্ডল জানান, গত ১১ জানুয়ারী জসিম উদ্দীন সিলেট থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন। পরদিন ১২ ফেব্রুয়ারি গোয়ালন্দ ঘাট পার হয়ে জসিম তার বাবাকে জানান, ডিবি পুলিশ পরিচয়ে সাদা পোশাকের লোকজন তাদের বাসটি চেক করবে বলে থামিয়েছে। এরপর থেকেই জসিমের মোবাইল বন্ধ রয়েছে। ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজবাহার আলী শেখ জানান, আবু হুরাইরা ও জসিম নামে কাউকে পুলিশ আটক করেনি। তাদের কোন তথ্যও পুলিশের কাছে নেই। অথচ দুই পরিবারের লোকেরা জিডি করতে গেলে তা নেওয়া হয়নি। 

নিখোঁজ হওয়ার ২২ দিন পর ২০১৬ সালের ৪ মার্চ ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডুর হিঙ্গার গ্রামের একটি মাঠ থেকে থেকে জসিম উদ্দিনের হাত-পা বাঁধা গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। সকালে কৃষকরা মাঠে কাজ করতে গিয়ে অজ্ঞাত এক যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ দেখতে পেয়ে পুলিশকে খবর দেয়। তাকে চোখ ও পেছনে হাত বেধে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। খবর পেয়ে পুলিশ সকাল ১০টার দিকে লাশ উদ্ধার করে হরিণাকুণ্ডু থানায় নেয়। ঝিনাইদহ জেলা ছাত্রশিবিরের সভাপতি আনোয়ার হোসেন জানান, নিহত জসিম উদ্দিন ঝিনাইদহের গান্না ইউনিয়নের শিবিরের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলেন। পুলিশ শিবির নেতা জসিমকে আটকের পর অস্বীকার করছে। গতকাল শুক্রবার সকালে হরিণাকুণ্ডু উপজেলার হিঙ্গেরপাড়া গ্রামের মাঠ থেকে তার গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। 

নিহতর ভাই সাইফুর রহমান জানান, গত ১২ ফেব্রুয়ারি সিলেট থেকে বাসযোগে বাড়ি ফেরার পথে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে গোয়ালন্দ ঘাট থেকে জসিমকে নামিয়ে নেয়। সেই থেকে জসিম নিখোঁজ ছিলো। শুক্রবার সকালে হরিণাকুণ্ডু উপজেলার হিঙ্গেরপাড়া মোস্তবাপুর গ্রামের মাঠে মুখ ও পিঠমোড়া করে হাত-বাধা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায় জসিমের। সাইফুর রহমান অভিযোগ করেন, তার ভাইকে প্রশাসনের সহায়তায় পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।

ঝিনাইদহে আজবাহার আলী গং-দের ৩য় ও ৪র্থ শিকার হলেন আবু যর গিফারী ও শামীম হোসেন। ২০১৬ সালের ১৮ মার্চ দুপুরে জুমআর নামাজের পর ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় চাপালী গ্রামের ইসলাম আলীর ছেলে আবু জর গিফারীকে। তাঁর বয়স ২২ বছর। তিনি যশোর এম এম কলেজের অনার্সের ছাত্র। এর পরদিন ২৪ মার্চ বিকেলে বাকুলিয়া গ্রামের রুহুল আমিনের ছেলে শামীম হোসেনকে পুলিশ পরিচয়ে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর বয়স ২০ বছর। তিনি ঝিনাইদহ সরকারি কে সি কলেজের ছাত্র। 

আবু জর গিফারী ছাত্রশিবিরের কালীগঞ্জ পৌর শাখার সভাপতি ও শামীম হোসেন ছাত্রশিবিরের কর্মী ছিলেন। আবু জর গিফারীর পিতা ইসলাম আলী গণমাধ্যমকে বলেন, ২৭ দিনেও তিনি তাঁর ছেলে আবু জর গিফারীকে ফেরত পাননি। ১৮ মার্চ জুমার নামাজ পড়ে ফেরার সময় বাড়ির সামনে অপেক্ষমাণ দুটি মোটরসাইকেলে চারজন লোক ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে গিফারীকে জোর করে তুলে নিয়ে যায়। তাদের কাছে পিস্তল ও হ্যান্ডকাপ ছিল। তিনি আরো বলেন, ‘ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পর কালীগঞ্জ থানায় একটি জিডি করার জন্য আবেদন করি। পুলিশ আবেদনটি রেখেছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে জিডি হিসেবে আর লিপিবদ্ধ করেনি।’ 

আরেক অপহৃত ছাত্র শামীম হোসেনের বাবা বাকুলিয়া গ্রামের মাদ্রাসাশিক্ষক রুহুল আমিন গণমাধ্যমকে বলেন, তাঁর ছেলে ২৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে সন্ধ্যায় কালীগঞ্জ শহরের মাহতাব উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের পাশ দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। সেখানে অপেক্ষায় থাকা কয়েক ব্যক্তি ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তাঁকে অস্ত্র দেখিয়ে তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তাঁর খোঁজ মিলছে না। 

২০১৬ সালের ১২ এপ্রিল আবু যর গিফারী ও শামীম হোসেনের লাশ একসাথে পাওয়া যায়। সেদিন সকালে ঝিনাইদহের বারোবাজার সীমান্তে যশোর সদরের লাউখালি শ্মশান এলাকা থেকে তাদের ক্ষতবিক্ষত ও গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তারা যথাক্রমে ১৮ ও ২৪ মার্চ পুলিশ কর্তৃক অপহৃত হয়েছিলেন। 

প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরা জানান, লাউখালী গ্রামের মাঠে একটি শ্মশান রয়েছে। ১২ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে মাঠে কাজ করতে আসা লোকজন ওই শ্মশানে দুটি লাশ পড়ে থাকতে দেখেন। তাঁরা যশোর থানার পুলিশকে জানালে যশোর কোতোয়ালি থানার পুলিশ এসে লাশ দুটি উদ্ধার করে নিয়ে যায়। পরে গিফারীর চাচাতো ভাই পান্নু মিয়া গিফারীকে শনাক্ত করেন। শামীম হোসেনের ভাই তাজনিম হোসেন তাঁর মরদেহ শনাক্ত করেন।

যশোর হাসপাতাল মর্গের সামনে আবু জর গিফারীর ফুপা আক্কাস আলী গণমাধ্যমকে বলেন, গিফারীকে গত ১৮ মার্চ বাড়ি থেকে পুলিশ পরিচয়ে সাদাপোশাকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে নিয়ে যায়। এরপর থানায় খোঁজ করা হলেও তাঁর খোঁজ মেলেনি। গিফারী ছাত্রশিবিরের কালীগঞ্জ পৌর শাখার সভাপতি ছিলেন। শামীমের মামা ইমরান হোসেন বলেন, ২৪ মার্চ বিকেলে শামীম কালীগঞ্জের মাহতাব উদ্দীন ডিগ্রি কলেজের সামনের একটি দোকানে পত্রিকা পড়ছিলেন। এ সময় দুটো মোটরসাইকেলে হেলমেট পরা চারজন এসে শামীমকে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আশপাশের লোক ধাওয়া দিলে পিস্তল বের করে তাঁরা নিজেদের পুলিশের লোক বলে পরিচয় দেন। এরপর থানায় খোঁজ করলে শামীমের খোঁজ মেলেনি। 

কালীগঞ্জ থানা পুলিশ আটকের বিষয় অস্বীকার করে। একইসাথে জিডিও নেয়নি। এই চারজন নিরীহ মানুষ হত্যার ঘটনায় তাদের পরিবার ও তাদের রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াত সন্দেহাতীতভাবে পুলিশকে দায়ী করেছেন। সুনির্দিষ্টভাবে ৪টি খুনের জন্যই এএসপি আজবাহার আলী শেখ ও ঝিনাইদহ ডিবি পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম এ হাসেম খান দায়ী। এর বাইরে আবু হুরাইরা খুনের জন্য হাসান হাফিজুর রহমান (ওসি, সদর, ঝিনাইদহ) দায়ী। হাফেজ জসিম উদ্দিন জসিম উদ্দিন খুনের জন্য মাহাতাব উদ্দীন (ওসি, হরিণাকুন্ডু, ঝিনাইদহ) ও হাসান হাফিজুর রহমান (ওসি, সদর, ঝিনাইদহ) দায়ী। আবু জর গিফারী ও শামীম হোসেন খুনের জন্য আনোয়ার হোসেন (ওসি, কালিগঞ্জ, ঝিনাইদহ), নীরব হোসেন (এসআই, সদর, ঝিনাইদহ) ও নাসির উদ্দিন (এসআই, সদর, ঝিনাইদহ) দায়ী।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন