উসমান রা.-কে যখন হত্যা করা হলো তখন উম্মুল মুমিনিন উম্মু হাবিবা রা. উসমান রা.-এর পরিবার থেকে তাঁর রক্তাক্ত জামা সংগ্রহ করেন। উম্মু হাবিবা রা. নিজেও ছিলেন উমাইয়া গোত্রের। তিনি আবু সুফিয়ানের কন্যা ও মুয়াবিয়া রা.-এর বোন। উম্মু হাবিবা রা. উসমান রা.-এর রক্তাক্ত পোষাক সাথে দিয়ে নুমান বিন বশীর রা.-কে সিরিয়ার তাঁর ভাই মুয়াবিয়া রা.-এর নিকট পাঠান। সাথে উসমান রা.-এর কিছু চুল, দাড়ি ও একটি চিঠিও পাঠান। যেখানে তিনি ভাই মুয়াবিয়া রা.-কে অনুরোধ করেন উসমান রা. হত্যার বদলা নেয়ার জন্য।
নুমান রা. এসব নিয়ে সিরিয়ায় পৌঁছান। মুয়াবিয়া রা. সব শুনেন। এরপর তিনি নুমান রা.-কে মিম্বারে বসান যাতে সবাই নুমান রা.-কে দেখতে পায় ও শুনতে পায়। মুয়াবিয়া রা. উসমান রা.-এর রক্তাক্ত জামা উপরে তুলে ধরেন। সিরিয়ায় মুসলিমরা এই দৃশ্য দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তারা সবাই উসমান রা. হত্যার প্রতিশোধ নিতে বাইয়াত নিতে থাকেন। মুয়াবিয়া রা. এরপর আলী রা.-এর বাইয়াত গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। যতক্ষণ না উসমান রা.- হত্যার বদলা না নেওয়া হবে ততক্ষণ পর্যন্ত আলী রা.-এর আনুগত্য করতে অস্বীকার করেন। আলী রা. মুয়াবিয়া রা.-এর কাছে কয়েকটি চিঠি পাঠান ও দূত পাঠান। মুয়াবিয়া রা. বাইয়াত বা সমঝোতা কোনোটাতেই রাজি ছিলেন না।
তার ভাষ্যমতে তিনি উসমান হত্যাকারীদের দখল থেকে মদিনাকে উদ্ধার করবেন। এই লক্ষ্যে তিনি সৈন্য সমাবেশ করতে লাগলেন। এই সমাবেশ মূলত আলী রা.-এর বিরুদ্ধে। তবে আলী রা.-এর খিলাফত গ্রহণ অবৈধ বা আলী রা. আবৈধ শাসক এমন কোনো মতামত মুয়াবিয়া রা.-থেকে পাওয়া যায়নি। মুয়াবিয়া রা.-এর দাবি মূলত উসমান হত্যার বদলা। আলী রা. যদি বদলা নিতে পারে তবে তিনি আলী রা.-কে মান্য করবেন নতুবা নয়। অন্যদিকে আলী রা. তাঁকে এর জন্য ধৈর্য ধরতে ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য অপেক্ষা করতে বলেছিলেন। মুয়াবিয়া রা. তা মানতে অস্বীকার করেন। উসমান রা. হত্যার বদলা নিতে দেরি করায় তিনি আলী রা.-এর বিরুদ্ধে সৈন্য সমাবেশ করেন ও বিদ্রোহের প্রস্তুতি নেন।
আলী রা.-ও ইসলামী রাষ্ট্রের সংহতি রক্ষায় সেনাবাহিনী প্রস্তুত করেন। সিরিয়ার বিদ্রোহ দমনে সেনাবাহিনী তৈরি করা হলেও বসরায় আগেই আয়িশা রা. বিদ্রোহের ঘোষণা দেন। তাই আলী আলী রা. আগে বসরার দিকে রওনা করেন। সেখানে হৃদয়বিদারক উটের যুদ্ধের ঘটনা ঘটে। আলী রা. বিজয়ী হন। আলী রা. জামাল যুদ্ধ পরিসমাপ্তির পর বসরায় প্রবেশ করলেন এবং উম্মুল মু'মিনীন আয়েশা রা. মক্কায় প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছা করলে তাঁকে সসম্মানে বিদায় জ্ঞাপন করলেন। বসরায় কিছুদিন থাকার পর তিনি কুফায় ফিরে গেলেন।
কুফার নেতৃস্থানীয় লোকেরা আলী রা.-কে পারস্য সাম্রাজ্যের শ্বেত প্রাসাদে থাকতে অনুরোধ করেন। আলী রা. বিলাসী জীবন যাপন পছন্দ করতেন না বলে সেখানে থাকতে অস্বীকার করেন। এজন্য তিনি উমার রা.-এর উদাহরণ পেশ করে বলেন, উমার রা. এই প্রাসাদে অবস্থান করতেই অপছন্দ করেছেন। তিনি কুফার কেন্দ্রীয় মসজিদে দুই রাকাআত নফল নামাজ আদায় করেন। তারপর কুফাবাসীর সামনে ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি কল্যাণ ও ভাল কাজে উদ্বুদ্ধ করলেন এবং মন্দ কাজ হতে নিষেধ করলেন। এ ভাষণে তিনি কুফাবাসীদের প্রশংসা করলেন। কুফা থেকেই তিনি ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু করলেন। ফলশ্রুতিতে কুফা রাজধানীতে পরিণত হলো। তিনি জারীর ইবন আবদুল্লাহ্ রা. ও আশাআছ ইবন কায়স রা.-এর কাছে তাদের শাসনাধীন অঞ্চলের জনতার বায়'আত গ্রহণ করে তাঁর কাছে আসার জন্য পত্রাদেশ পাঠালেন।
জারীর উসমান রা.-এর সময়কাল হতে হামাদানের শাসনকর্তা ছিলেন এবং আশ'আছ ও উসমান রা.-এর সময়কাল হতে আযারবাইজানের শাসনকর্তা ছিলেন। তারা এ আদেশ প্রতিপালন করলেন। পরে আলী রা. তাঁর প্রতি আনুগত্যের বায়'আতের আহ্বান জানিয়ে মু'আবিয়া রা.-এর কাছে পত্র পাঠাবার ইচ্ছা করলে জারীর ইবন আব্দুল্লাহ রা. বললেন, 'আমীরুল মু'মিনীন, তাঁর কাছে আমাকে যেতে দিন! কেননা, তাঁর সংগে আমার হৃদ্যতার সম্পর্ক রয়েছে। কাজেই আমি আপনার অনুকূলে তার বায়'আত হাসিল করার আশা রাখি।'
আলী রা. তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন এবং তাঁর হাতে মু'আবিয়া রা.-এর কাছে একটি পত্র লিখে পাঠালেন। পত্রে তিনি তাকে মুহাজির ও আনসারদের তাঁর বায়'আতে সমবেত হওয়ার কথা অবহিত করলেন এবং জামাল যুদ্ধের আদ্যোপান্ত অবহিত করলেন। তিনি মু'আবিয়া রা.-কে লোকদের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করে তাঁর বায়'আতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আহ্বান জানালেন। জারীর ইবন আবদুল্লাহ্ রা. মু'আবিয়া রা.-এর কাছে পৌঁছে পত্রটি তাঁর হাতে সমর্পণ করলেন। মু'আবিয়া রা. 'আমর ইবনুল আস রা. ও সিরিয়ার নেতৃস্থানীয়দের উপস্থিত করে তাদের কাছে এ বিষয়ে পরামর্শ চাইলেন। তারা উসমান হত্যাকারীদের হত্যা করা অথবা তাদের শাম কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া ব্যতীত বায়'আত করার ব্যাপারে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করল। অন্যথায় তারা আলী রা.-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা এবং উসমান হত্যাকারীদের হত্যা না করা পর্যন্ত আলী রা.-এর হাতে বায়'আত না করার সিদ্ধান্ত নিল। জারীর রা. আলী রা.-এর কাছে ফিরে এসে তাঁকে মুয়াবিয়া রা.-এর বক্তব্য অবহিত করলেন।
আমীরুল মু'মিনীন আলী রা. সিরিয়ায় যাওয়ার পরিকল্পনা করলেন এবং সেনা সমাবেশ করতে লাগলেন। কুফায় তিনি আবূ মাস'উদ আনসারী রা.-কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত নিয়োগ করলেন।
মু'আবিয়া রা.-এর কাছে আলী রা. নিজেই বাহিনী নিয়ে বেরিয়ে পড়ার সংবাদ পৌঁছাল। তিনি আমর ইবনুল আস রা.-এর কাছে এ বিষয়ে পরামর্শ জিজ্ঞেস করলেন। আমর রা. বললেন, আপনিও নিজেই বেরিয়ে পড়ুন। তখন আমর রা. জনতার সামনে ভাষণ দিলেন। ভাষণে তিনি বললেন, 'জামাল যুদ্ধে কুফা ও বসরার নেতৃস্থানীয় লোকগুলো নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। আলীর সঙ্গে মাত্র গুটিকতক লোকই রয়েছে- যারা ইতিপূর্বে খলীফা ও আমীরুল মু'মিনীন 'উসমান ইব্ন আফ্ফান রা.-কে শহীদ করেছেন। কাজেই সাবধান! তোমাদের সত্য ও হক নষ্ট করার ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। এবং তোমাদের রক্তের দাবি পরিত্যাগ করার ব্যাপারে মহান আল্লাহকে ভয় কর। অল্পসময়েই সিরিয়ার সেনাবাহিনীর প্রস্তুত হলো। সেনানায়কদের ছোট-বড় পতাকা প্রদান করা হলো। এভাবে মুয়াবিয়া রা. সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে ফোরাতের পথে সিফ্ফীন অভিমুখে রওয়ানা করল। যে দিক থেকে 'আলী রা. এগিয়ে আসছিলেন।
আলী রা.-এর বাহিনীতে আশিজন বদরী সাহাবী এবং (হুদায়বিয়ার) বৃক্ষছায়ায় বায়'আত গ্রহণীকারী একশত পঞ্চাশ জন সাহাবী ছিলেন। আলী রা. অগ্রবর্তী বাহিনীরূপে আট হাজার লোকসহ যিয়াদ ইবনুন নায়র হারিছীকে সামনে পাঠিয়ে দিলেন। শুরায়হ ইব্ন হানি আরও চার হাজার নিয়ে তার অনুগামী হলো। তারা আলী রা.-এর গমন পথ ছেড়ে অন্য পথে সামনে এগিয়ে চলল। 'আলী রা. তাঁর বাহিনী নিয়ে পৌঁছে গেলেন এবং মু'আবিয়া রা.-ও তাঁর বাহিনী নিয়ে সিফফিনে পৌঁছে গেলেন। তখন উভয় দল মুখোমুখি হলো ও সামনাসামনি দাঁড়িয়ে গেল। দীর্ঘ সময় ধরে উভয় পক্ষ স্থির দাঁড়িয়ে রইল।
আলী রা. সরে গিয়ে তাঁর বাহিনীর জন্য একটি উপযোগী স্থানের সন্ধান করলেন। কেননা, মু'আবিয়া রা. তাঁর বাহিনী নিয়ে আগেই পৌঁছে গিয়েছিলেন এবং পানির ঘাটের কাছে (পানির সুব্যবস্থা সম্পন্ন) বিস্তীর্ণ পরিসর যুক্ত সমতল স্থানে অবস্থান নিয়েছিলেন।
আলী রা. আগমন করার পরে তাঁকে পানি থেকে দূরবর্তী স্থানে অবস্থান নিতে হলো। ইরাকী বাহিনীর তাড়াহুড়াকারীরা পানির ঘাটে যাওয়ার চেষ্টা করলে সিরিয়া বাহিনী তাদের বাধা দিল। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে ছোটখাট লড়াই হয়ে গেল। মু'আবিয়া রা. পানির ঘাটের দখল কর্তৃত্ব আবুল 'আওয়ারের দায়িত্বে ন্যস্ত করেছিলেন এবং সেখানে অন্য কোন সুবিধাজনক জলাধার ছিল না।
ফলে আলী রা.-এর বাহিনী তীব্র পিপাসায় আক্রান্ত হলো। 'আলী রা. আশআছ ইব্ন কায়স কিন্দীকে একদল লোকসহ পানির দখল নেওয়ার জন্য পাঠালেন। প্রতিপক্ষ এই কথা বলে তাদের বাধা দিল যে, 'তোমরা পিপাসায় মরে যাও, যে রূপে তোমরা উসমান রা.-কে পানি হতে বঞ্চিত করেছিলে। এ সময় উভয় দল কিছুক্ষণ তীর ছুঁড়ে আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ চালাল। পরে তারা বল্লম দ্বারা আঘাত প্রতিঘাত করল। সবশেষে তারা তরবারি দিয়ে হানাহানিতে লিপ্ত হলো এবং পক্ষদ্বয়ের মূল বাহিনী নিজ নিজ দলের সাহায্যে এগিয়ে এল। যুদ্ধ পূর্বের চেয়ে প্রচণ্ড রূপ ধারণ করল।
প্রচণ্ড যুদ্ধে আলী রা.-এর বাহিনী ক্রমান্বয়ে মুয়াবিয়া রা.-এর বাহিনীকে পানি থেকে দখলচ্যুত করতে থাকল এবং এক সময় তাদের পানি হতে হটিয়ে দিয়ে তাদের ও পানির মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান নিল। আলী রা. পানির দখল নিলেন। এরপর আলী রা. বদান্যতা দেখালেন। উভয় বাহিনী পানির ব্যাপারে একটি সমঝোতায় উপনীত হলো এবং উভয়পক্ষ কেউ কাউকে হতাহত না করে এবং কেউ কাউকে পীড়ন না করে সে জলাধার হতে পানি নিতে লাগল।
আলী রা. বাশীর ইবন আমর আনসারী রা., সা'ঈদ ইব্ন কায়স হামাদানীসহ একদল লোককে ডেকে বললেন, তোমরা এ লোকের কাছে যাও এবং তাকে আনুগত্য ও একতাবদ্ধতার আহ্বান জানাও এবং সে কি জবাব দেয় তা শুনে এসো। তখন তারা মু'আবিয়া রা.-এর কাছে গেলেন এবং বাশীর ইব্ন আমর মু'আবিয়া রা.-কে বললেন, 'হে মু'আবিয়া! দুনিয়া আপনাকে ছেড়ে চলে যাবে, আপনাকে আখিরাতের দিকে ফিরে যেতে হবে। মহান আল্লাহ্ আপনার আমলের হিসাব নিবেন এবং আপনার হাত যা আগে (আমল করে) পাঠিয়েছে তার প্রতিদান দিবেন। আমি আপনাকে এ উম্মতের দলবদ্ধতাকে বিক্ষিপ্ত করার ব্যাপারে এবং তাদের পরস্পরের রক্ত প্রবাহিত করার ব্যাপারে কসম (দোহাই) দিচ্ছি!
মু'আবিয়া রা. বললেন, 'এ সদুপদেশ তোমাদের নেতাকে দিয়েছ তো? বাশীর বললেন, 'আমাদের নেতা তাঁর মাহাত্ম্য, তাঁর দীনদারী, তাঁর প্রবীণতা ও (রাসূলের সঙ্গে) তাঁর নিকটাত্মীয়তার কারণে এ (খিলাফতের) বিষয়টির জন্য এ সৃষ্টিকুলের মধ্যে সর্বাধিক অধিকারসম্পন্ন। তিনি আপনাকে তাঁর বায়'আত গ্রহণ করার আহ্বান জানাচ্ছেন। তা আপনার দুনিয়ার জন্য অধিক নিরাপত্তার কারণ হবে এবং আপনার আখিরাতের জন্য অধিক উত্তম হবে । মু'আবিয়া রা. বললেন, 'আর উসমান রা.-এর রক্ত কি দায়বিহীন হয়ে যাবে? না, আল্লাহ্র কসম! তা আমি কক্ষনো করব না।
এরপর আদী রা. বললেন, হে মু'আবিয়া! আমরা আপনাকে এমন একটি বিষয়ের দিকে আহ্বান করার জন্য এসেছি যা দিয়ে মহান আল্লাহ্ আমাদের বক্তব্য ও কর্মকে ঐক্যবদ্ধ করে দিবেন, রক্তবন্যা রহিত হবে, জনপথ নিরাপদ হবে এবং পারস্পরিক সম্পর্ক সুষ্ঠু হবে। নিশ্চয় আপনার চাচাত ভাই (আলী রা.) মুসলিম জাতির বরেণ্য নেতা, যিনি ইসলাম গ্রহণে অগ্রণী হওয়ার মর্যাদাসম্পন্ন এবং ইসলামের সেবায় উত্তম অবদানের অধিকারী। জনতা তাঁর পাশে সমবেত হয়েছে এবং মহান আল্লাহ্ তাদের সুবুদ্ধি সুমতি দিয়েছেন। আপনি এবং আপনার অনুগামী কিছু লোক যারা আপনার সংগে রয়েছে এদের ব্যতীত তেমন আর কেউ অবশিষ্ট নেই। কাজেই, হে মু'আবিয়া ! মহান আল্লাহ যেন আপনার ও আপনার সঙ্গীদের পরিণতি জামাল যুদ্ধের ন্যায় না করেন!
মু'আবিয়া রা. বললেন, তুমি তো দেখা যায় হুমকি দেওয়ার জন্য এসেছ, আপোসরফা করার জন্য নয় । আল্লাহর কসম! হে 'আদী! সুদূর পরাহত, কখনও নয়, আল্লাহর কসম। আমি হারবের পুত্র। অলীক ভীতি ও কালচক্র আমাকে নাড়াতে পারবে না। শোন! আল্লাহর কসম! তুমিও নিশ্চয় উসমান ইবন 'আফ্ফানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের উস্কানি দাতাদের অন্যতম, তুমি তাঁর হত্যাকরীদের একজন এবং আশা করি মহান আল্লাহ্ তাঁর বিনিময়ে যাদের হত্যা করবেন তুমিও হবে তাদের অন্তর্ভুক্ত।
পরে শুবায়ছ-ইন রিব'ঈ ও যিয়াদ ইব্ন খাসসাও কথা বললেন, তারা বললেন, হে মু'আবিয়া! আল্লাহকে ভয় করুন এবং ভার বিরুদ্ধাচরণ করবেন না। আল্লাহর কসম! আমরা 'আলী (রা)-এর চেয়ে অধিক তাকওয়ার কর্মপন্থা অনুসরণকারী, দুনিয়ার প্রতি অধিক বিমুখ ও মোহমুক্ত এবং সামগ্রিক সদগুণের সমন্বয়কারী অন্য কাউকে দেখিনি।
জবাবে মু'আবিয়া রা. আল্লাহর হাম্দ-স্তুতি করার পরে বললেন, তারপর তোমরা আমাকে সমষ্টিবদ্ধ হওয়ার ও আনুগত্যের আহ্বান করেছ। তবে জামা'আত ও সমষ্টি তো আমাদের সংগে রয়েছে। আর আনুগত্য! তা আমি কি করে এমন এক ব্যক্তির আনুগত্য করবো যে উসমান হত্যায় সহায়তা করেছে, তদুপরি সে দাবি করছে যে, সে তাঁকে হত্যা করেনি? আমরাও বিষয়টি তার প্রতি আরোপিত করি না এবং তাতে তাকে অভিযুক্ত করি না। কিন্তু সে তাঁর হত্যাকারীদের আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়েছে। কাজেই হয় সে তাদের (উসমান হন্তাদের) আমাদের হাতে তুলে দিবে, আমরা তাদের হত্যা করব, তারপর আমরা তোমাদের ঐক্যবদ্ধতা ও আনুগত্যের আহ্বানে সাড়া দিব।
জবাবে শুবায়ছ ইব্ন রিব'ঈ বলল, হে মু'আবিয়া! আমি আপনাকে আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করছি, আপনি আম্মার রা.-কে হাতে পেয়ে গেলে তাকে কি উসমান রা.-এর বদলে হত্যা করতে পারবেন? মু'আবিয়া রা. বললেন, আমি সুমাইয়ার পুত্রকে হাতে পেয়ে গেলে তাকে উসমান রা.-এর বদলে হত্যা করব না, তবে তাকে উসমান রা.-এর গোলাম (নাতিল)-এর বদলে হত্যা করতাম। তখন রিব'ঈ বললেন, আসমান-যমীনের ইলাহের কসম! অনেক অনেক মস্তক তার গর্দান হতে বিচ্ছিন্ন না করে আপনি “আম্মার রা.-এর হত্যা সম্পাদন করতে পারবেন না। এবং তখন পৃথিবীর প্রশস্ত অঙ্গন ও প্রান্তর আপনার জন্য সংকীর্ণ হয়ে যাবে। মু'আবিয়া রা. বললেন, তাই যদি হয় তবে তোমার জন্য আরও অধিক সংকীর্ণ হবে।
তারপর তাঁদের তাঁর সামনে থেকে বের করে দেওয়ার আদেশ দিলেন এবং মজলুম রূপে শহীদ উসমান রা.-এর খুনের প্রতিবিধানের দাবিতে অবিচল থাকার কথা ঘোষণা করলেন। এ পরিস্থিতিতে উভয় দলের মধ্যে যুদ্ধের আগুন প্রজ্বলিত হলো। আলী রা. তাঁর অগ্রবর্তী বাহিনী ও সেনানায়কদের যুদ্ধ শুরু করার আদেশ দিলেন। তিনি প্রত্যেক উপদলের জন্য (প্রতিদিন) এক একজন আমীর নিয়োগ করলেন। তবে যুদ্ধ শুরু করার আগে দুই পক্ষের মধ্যে দূত চালাচালি চলতে লাগলো এবং বিতর্ক চলতে থাকলো।
ইবন জারীর লিখেছেন, 'তারপর 'আলী রা. ও মুআবিয়া (রা)-এর মধ্যে দূতদের আনাগোনা চলতে থাকল এবং লোকেরা যুদ্ধ হতে বিরত রইল। এভাবে মুহাররম মাস শেষ হয়ে গেল এবং দুই পক্ষে কোন প্রকার সন্ধি সম্পাদিত হলো না। পরে আলী রা. ইয়াযীদ ইব্ন ইবনুল হারিছ জুশামীকে আদেশ করলে সে সূর্যাস্তের সময় সিরিয়াবাসীদের লক্ষ্য করে এ ঘোষণা দিল। “শোন! আমীরুল মু'মিনীন তোমাদের অবহিত করছেন, ‘সত্যের দিকে তোমরা ফিরে আসবে এ উদ্দেশ্যে আমি তোমাদের জন্য দীর্ঘকাল প্রতীক্ষা করেছি এবং তোমাদের সামনে প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত করেছি, তোমরা তাতে সাড়া দাওনি। আমি এখন তোমাদের প্রতি সম্পর্ক ছিন্নতার স্পষ্ট ঘোষণা দিচ্ছি। আল্লাহ্ বিশ্বাস ভঙ্গকারীদের ভালবাসেন না।”
সিরিয়াবাসীরা অর্থাৎ মুয়াবিয়া রা.-এর অনুসারীরা এ ঘোষণা শুনে তাদের আমীরগণের কাছে ছুটে গেল এবং ঘোষকের ঘোষণা সম্বন্ধে তাদের অবহিত করল। তখন মু'আবিয়া রা. ও আমর ইবনুল আস রা. উঠে পড়লেন এবং বাহিনীকে ডান ও বাম দলে সজ্জিত করলেন। আলী রা.-ও রাতভর সেনা সজ্জা করলেন।
আলী রা. জনতার সামনে এসে বললেন, সিরিয়াবাসীরা যুদ্ধ শুরু না করা পর্যন্ত তারা যুদ্ধ শুরু করবে না; কোন আহতকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিবে না, কোন পলায়নকারীর পশ্চাদ্ধাবন করবে না, কোন নারীর পর্দা নষ্ট করবে না, বেইজ্জত করবে না। তারা আমীর, নেতৃবৃন্দ ও পুণ্যবানদের বকাবকি করলেও করবে না।
৩৭ হিজরির সফর মাসের প্রথম দিন এভাবেই তারা পরস্পর মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়াল। দিনটি ছিল বুধবার। এ দিনের যুদ্ধে ইরাকীদের সেনাপতি ছিল আশতার নাখ'ঈ এবং সিরিয়দের সেনাপতি ছিল হাবীব ইবন মাসলামা। এদিন তারা প্রচণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত হলো এবং দিন শেষে নিজ নিজ অবস্থানে ফিরে গেল। যুদ্ধের ফলাফলে উভয় পক্ষ ছিল সমান সমান- এক পক্ষ অপর পক্ষকে সমান সমান প্রতিঘাত করল ।
পরদিন বৃহস্পতিবার সকালে আবার তারা যুদ্ধ শুরু করল। এদিন ইরাকীদের সেনাপতি ছিল হাশিম ইব্ন উতবা এবং সিরিয়দের সেনাপতি ছিল আবুল আ'ওয়ার সুলামী। এদিনও তারা প্রচণ্ড যুদ্ধ করল। অশ্বারোহীরা অশ্বারোহীদের উপর এবং পদাতিকরা পদাতিকদের উপর আক্রমণ চালাল। দিন শেষে তারা নিজ নিজ অবস্থানে ফিলে গেল। এ দিনের যুদ্ধে পক্ষদ্বয় একে অপরের সামনে দৃঢ়তার পরিচয় দিল এবং যুদ্ধের ফলাফল ছিল সমানে সমান ।
তৃতীয় দিন শুক্রবার উভয় পক্ষ ময়দানে এল। এ দিন ইরাকীদের পক্ষে সেনাপতি ছিলেন 'আম্মার ইবন ইয়াসির রা. এবং সিরিয়দের নিয়ে ময়দানে এলেন 'আমর ইবনুল আস রা.। লোকেরা এদিনও প্রচণ্ড যুদ্ধ করল এবং এক পর্যায়ে 'আমর ইবনুল আস রা. 'আম্মার রা.-এর উপর আক্রমণ চালিয়ে তাঁকে তাঁর অবস্থান হতে হটিয়ে দিলেন। বিকালে উভয় পক্ষ নিজ নিজ অবস্থানে ফিরে গেল। এদিনের যুদ্ধেও উভয়পক্ষ বীরত্ব ও দৃঢ় অবস্থানের পরাকাষ্ঠা দেখাল। যুদ্ধে আলী রা. বাহিনী এগিয়ে থাকলেও আম্মার রা. শাহদাতবরণ করেন। এই বিষয়ে রাসূল সা.-এর একটি ভবিষ্যৎবাণী ফলে যায়। আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন, হে আম্মার! সুসংবাদ গ্রহণ কর, বিদ্রোহী দলটি তোমাকে হত্যা করবে। এটা দ্বারা নিশ্চিত হয় আম্মার রা.-এর হত্যাকারীরা ইসলামী রাষ্ট্রের বিদ্রোহী ও সঠিক পথে ছিল না।
যদিও মুয়াবিয়া রা. এই ব্যাপারে উল্টা যুক্তি দেন, তিনি বলেছেন, যারা আম্মারকে যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে এসেছে তারাই মূলত আম্মারের খুনী। এর পাল্টা বক্তব্যে আলী রা. বলেন, তোমার যুক্তিমতে আমীর হামজা রা.-এর খুনী স্বয়ং মুহাম্মদ সা.। কারণ ওহুদে তিনি গিয়েছেন মুহাম্মদ সা.-এর আহ্বানে।
চতুর্থ দিন শনিবার পুনরায় দুই বাহিনী ময়দানে এল। এ দিন ইরাকী বাহিনীর পরিচালনায় ছিলেন মুহাম্মদ ইব্ন 'আলী রা. (যিনি মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফিয়া নামে সমধিক পরিচিত)। তাঁর সঙ্গে ছিল বিশাল বাহিনী। এ দিন সিরিয়দের বিশাল বাহিনীর নেতৃত্ব করছিলেন উবায়দুল্লাহ্ ইবন উমর রা.। এদিনও উভয় পক্ষ প্রচণ্ড যুদ্ধ করল। উবায়দুল্লাহ্ ইবন 'উমর রা. সামনে বেরিয়ে এসে মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফিয়াকে দ্বৈতযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার আহ্বান জানালেন। ইবনুল হানাফিয়াও সামনে এগিয়ে গেলেন।
দুইজন পরস্পরের সন্নিকট হওয়ার প্রাক্কালে 'আলী রা. বললেন, দ্বৈত যুদ্ধে অবতীর্ণ হলো কে কে? লোকেরা বলল, আপনার ছেলে মুহাম্মাদ ও উবায়দুল্লাহ্ বর্ণনামতে, 'আলী রা. তাঁর বাহনটি দ্রুত চালিয়ে নিয়ে ছেলেকে বিরত থাকার আদেশ দিলেন এবং নিজে উবায়দুল্লাহর কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন, আমার সংগে এগিয়ে এস। উবায়দুল্লাহ্ বললেন, আপনার সঙ্গে দ্বৈতযুদ্ধে আমার প্রয়োজন নেই। 'আলী রা. বললেন, কেন নয়? উবায়দুল্লাহ্ বলল, না। তখন আলী রা. ফিরে এলেন এবং লোকেরা সে দিনের জন্য যুদ্ধে বিরতি দিল।
পঞ্চম দিন রবিবার আবার দুই বাহিনী ময়দানে হাজির হলো। এদিন ইরাকীদের নেতৃত্বে ছিলেন আবদুল্লাহ্ ইব্ন আব্বাস রা. এবং সিরিয়দের নেতৃত্বে ছিলেন ওয়ালীদ ইব্ন উবা রা.। যুদ্ধ চলল প্রচণ্ড রূপে। এভাবে প্রতিদিন যুদ্ধ চলতে লাগলো।
একদিন আলী রা. আওয়াজ দিয়ে বললেন, হে মু'আবিয়া... (হিম্মত থাকে তো) তুমি আমার সামনে বেরিয়ে এসো। যাতে আমার ও তোমার দৃষ্টির সামনে আরবের মানুষগুলোর জীবন নাশ ঘটতে না থাকে। আওয়ায শুনে 'আমর ইবনুল আস রা. মু'আবিয়া রা.-কে বললেন, 'এ সুযোগ গ্রহণ করো! মু'আবিয়া রা. বললেন, আল্লাহর কসম! তুমি নিশ্চিতই জান যে, 'আলী কখনও পরাভূত হয়নি। তোমার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমি নিহত হই, যাতে তুমি আমার পরে নির্বিঘ্নে খিলাফতের মসনদ দখল করতে পার। তুমিই যাও না কেন? আমার মত লোককে প্রতারিত করা যায় না।
অবশেষে আমর ইবনুল আস রা. আলী রা.-এর মুকাবিলায় আসলেন। দন্দ্বযুদ্ধে 'আলী রা. আমর ইবনুল আস রা.-কে আক্রমণ করলেন এবং বল্লম দ্বারা আঘাত করে তাঁকে মাটিতে ফেলে দিলেন। মাটিতে পড়ে যাওয়ার সময় ‘আমর (রা)-এর লজ্জাস্থান উন্মুক্ত হয়ে গেলে আলী রা. সেখান হতে চলে গেলেন। আলী রা.-এর লোকেরা তাঁকে বললেন, আমীরুল মু'মিনীন! কি ব্যাপার, তাকে ছেড়ে দিলেন কেন? তিনি বললেন, তোমরা কি জান, সে কে (কি ঘটেছে)? তারা বলল, না তিনি বললেন, এই তো 'আমর ইবনুল আস, তার লজ্জাস্থান উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল, তা আমার মনে দায়ার্দ্রতার উদ্রেক করেছে, একারণে আমি সরে এসেছি। পরে আমর রা. মু'আবিয়া রা.-এর কাছে ফিরে গেলে তিনি বললেন, আমি আল্লাহর প্রশংসা করছি- এবং তোমার 'পাছা'রও প্রশংসা করছি। (যেটা তোমাকে জীবন রক্ষা করেছে।)
এরপর বিশাল একদল নিয়ে মুহাম্মাদ ইবনে আলীকে অগ্রবর্তী করা হলো। প্রতিপক্ষ প্রচণ্ডরূপে যুদ্ধ করলে 'আলী রা. অপর একটি দল নিয়ে এগিয়ে চললেন এবং তাদের সঙ্গে নিয়ে আক্রমণ করলেন। এ সময় উভয় দলের অনেক অনেক লোক নিহত হলো যাদের সঠিক সংখ্যা আল্লাহই ভাল জানেন । ইরাকী পক্ষে নিহতের সংখ্যাও ছিল অনেক। এ সময় মাগরিবের সালাতের সময় হয়ে গেল। কিন্তু যুদ্ধের প্রচণ্ডতার কারণে 'আলী রা. লোকদের নিয়ে মাগরিব ও ইশার সালাত ইশারায় আদায় করতে বাধ্য হলেন। এ রাতে রাতভর যুদ্ধ চলতে থাকল এবং রাতটি ছিল মুসলমানদের ইতিহাসে নিকৃষ্টতার বিচারে চরম স্তরের। রাতটি 'লায়লাতুল হারীর' (অপছন্দনীয় বা অকল্যাণকর রাত) নামে অভিহিত। রাতটি ছিল জুমু'আর পূর্ববর্তী রাত। এ রাতে বল্লমগুলো ভেঙ্গে চুড়ে গেল, তীর ফুরিয়ে গেল এবং লোকেরা তরবারি হাতে তুলে নিল।
আলী রা. বিভিন্ন গোত্রকে উদ্বুদ্ধ করে চলছিলেন এবং তাদের কাছে গিয়ে স্থির অবিচল থাকার উপদেশ দিচ্ছিলেন। তিনি ছিলেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর সন্মুখ ভাগে; ডান বাহুর পরিচালনায় ছিল আশতার। বৃহস্পতিবার বিকালে আব্দুল্লাহ্ ইব্ন বুদায়ল নিহত হলে শুক্রবারের পূর্ববর্তী রাতে আশতার ডান বাহুর পরিচালন-দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল। বাম বাহুর দায়িত্ব দিলেন আব্দুল্লাহ্ ইব্ন আব্বাস রা.-কে। সব দিকেই লোকেরা যুদ্ধ করে চলছিল।
শুক্রবার সকাল হওয়া পর্যন্ত তাদের এ অবস্থা চলতে থাকল। ফজরের সালাত তারা যুদ্ধরত অবস্থায় ইশারায় আদায় করল। এভাবে দিনের প্রথম প্রহর পার হয়ে গেল- এবং মুয়াবিয়ার বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হলো। ইরাকীদের জয়ের পাল্লা ভারী হয়ে উঠল। এর কারণ ছিল এই যে, ডান বাহুর পরিচালনা আশতার নাখ'ঈর দায়িত্বে ন্যস্ত হলে সে তার বাহিনী নিয়ে সিরিয়দের বিরুদ্ধে শক্ত আক্রমণ পরিচালিত করল এবং 'আলী রা. তাঁর বাহিনী নিয়ে আশতারের অনুগমন করলে সিরিয়দের প্রায় সকল সারি ভেঙ্গে গেল এবং পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হলো। মুয়াবিয়া বাহিনীর পরাজিত হওয়া নিশ্চিত প্রায় এমন সময়ে মুয়াবিয়ার সৈন্যরা বর্শার মাথায় কুরআন শরীফ তুলে ধরে আওয়াজ দিতে লাগল- “আমাদের ও তোমাদের মাঝে এটিই ফয়সালা করবে। লোকজন শেষ হয়ে গেলে (ইসলামী রাষ্ট্রের) সীমান্ত রক্ষা করবে কারা?
আমর রা. মু'আবিয়া রা.-কে বললেন, আমি একটি বুদ্ধি ঠিক করেছি যা বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের দলের সমন্বিত হওয়ার অধিক সুযোগ সৃষ্টি করতে এবং ওদের বিভক্তি বাড়িয়ে দিবে। আমার মতে আমরা কুরআন শরীফ তুলে ধরে ওদের সেদিকে আহ্বান করব। তাদের সকলে এ আহ্বানে সাড়া দিলে যুদ্ধ স্তিমিত হয়ে যাবে। আর তারা এতে মতবিরোধে লিপ্ত হলে একদল বলবে আমরা তাদের আহ্বানে সাড়া দেই, অপর দল বলবে-না, আমরা সাড়া দিব না। এতে তারা হীনবল হয়ে পড়বে এবং যুদ্ধে তাদের প্রভাব শেষ হয়ে যাবে। বস্তুত তাই হলো। আলী রা. ও তাঁর অনুসারীরা কুরআন দেখে থেমে গেল।
আলী রা.-এর বাহিনীর বড় একটা অংশ যুদ্ধ বন্ধ করে রক্তক্ষয় বন্ধ করতে চাইলো। তবে একটা অংশ যুদ্ধ বন্ধের বিরোধী ছিল। তারা বলেছে এটা আমর রা. ও মুয়াবিয়া রা.-এর কৌশল। তারা যুদ্ধের সুবিধা নিতে এই কাজ করছে। এটা আলী রা.-ও বুঝতে পেরেছেন কিন্তু তিনি মানুষের রক্তক্ষয় বন্ধের সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না। উভয়পক্ষেই মুসলিমরা মৃত্যুবরণ করছে।
যাই হোক, ইরাকীদের অধিকাংশ ও সিরিয়দের সকলেই অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও সন্ধি ও যুদ্ধবিরতির প্রতি আগ্রহান্বিত হলো। তাদের লক্ষ্য ছিল হয়তো এভাবে এমন কোন ঐকমত্য সৃষ্টি হবে যা মুসলমানদের জীবন রক্ষা করবে। কেননা, বিগত সংঘাতের দিনগুলিতে অগণিত মুসলিম নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। উভয়পক্ষ সালিশের বিনিময়ে যুদ্ধ বন্ধে সম্মত হলেন। এর মাধ্যমে সিফফিনের যুদ্ধের সমাপ্তি হলো।
আলী রা.-এর পক্ষে সেনা কমান্ডাররা ছিলেন, হাসান, হুসাইন, মুহাম্মদ ইবনে আল হানাফিয়াহ, মালিক আল-আশতার, কায়েস ইবনে সাদ, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আম্মার, উয়াইস করনি, খুজাইমা ইবনে সাবিত, হাশিম ইবনে উতবাহ, মুহম্মদ ইবনে আবী বকর, মুহাজির ইবনে খালিদ, আবদুল্লাহ ইবন বুদায়েল প্রমূখ।
মুয়াবিয়া রা.-এর পক্ষে কমান্ডাররা হলেন, আমর ইবনুল আস, মারওয়ান ইবনুল হাকাম, আবু আল আওয়ার, হাবিব ইবনে মাসলামা, বুসার ইবনে আবি আরতাত, উতবা ইবনে আবি সুফিয়ান, মুসলিম ইবনে উকবা, আল-হুসাইন ইবনে নুমায়ার, আল-দাহক ইবনে কায়েস, জাফর ইবনে হারিস, ইবনে বাদল, উবায়েদুল্লাহ ইবনে উমর, আব্দুর রহমান ইবনে খালিদ প্রমূখ।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন