৭ এপ্রি, ২০২৩

বঙ্গবাজারে আগুন! দায়ী কে?

বঙ্গবাজার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এর দায় কার? আমার হিসেবে এর দায় সরকার, সিটি কর্পোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, বঙ্গবাজার ব্যবসায়ী সমিতি, হাইকোর্টের বিচারপতি ও জার্মানভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম ডয়েচে ভেলে। 

ফুলবাড়িয়ায় বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় পড়েছে। পাশাপাশি লাগোয়া চারটি বিপণিবিতানের সমন্বিত নাম বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স। এর মালিকানায় রয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। সিটি করপোরেশনের হিসাবে, টিন-কাঠের অবকাঠামোতে তৈরি বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে ২ হাজার ৯৬১টি দোকান রয়েছে।

কিন্তু বাস্তবে দোকানের সংখ্যা ছিল প্রায় দ্বিগুণ। আবার করপোরেশনের কাগজপত্রে এই বিপণিবিতান দোতলা। কিন্তু কমপ্লেক্সের কিছু অংশ তিনতলা। এই বিপণিবিতানের মালিক সমিতির নেতারা যে যার সুবিধামতো দোকান বাড়িয়ে নেওয়ার পাশাপাশি কমপ্লেক্সের কিছু তৈরি করে নিয়েছিলেন। 

২০১৯ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বড় বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটে এবং ফায়ার সার্ভিসের দূর্বলতা ভীষণভাবে ফুটে ওঠে। একইসাথে ভবনগুলো রাজউক ও ফায়ার সার্ভিসের নির্দেশিকা মেনে তৈরি হয়নি এই বিষয়টিও প্রকটভাবে ফুটে ওঠে। মিডিয়ায় রাজউক, সিটি কর্পোরেশন ও ফায়ার সার্ভিসের বিরুদ্ধে ব্যাপক কথাবার্তা হয়। এর প্রেক্ষিতে ফায়ার সার্ভিস নড়ে চড়ে ওঠে। তারা বিভিন্ন শপিং কমপ্লেক্স ও বিপণিবিতানে অনুসন্ধান চালায়। 

যেগুলো আগুনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ সেগুলোর তালিকা করে ও তাদেরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়। আর কিছু বিপণিবিতানকে খুবই ঝুঁকিপূর্ন হিসেবে চিহ্নিত করে ও ভেঙ্গে ফেলার পরামর্শ দেয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ন ছিল বঙ্গবাজার। বঙ্গবাজারের দোকান মালিক সমিতি ফায়ার সার্ভিসের এই সতর্কতাকে থোড়াই কেয়ার করে। ফায়ার সার্ভিস বার বার তাদের নোটিশ দেয়। বঙ্গবাজারের সামনে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ব্যানার টানিয়ে দেয়। তারপরেও কোনো ব্যবস্থা নেয় না দোকান মালিক সমিতি। ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল বঙ্গবাজারকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ব্যানার টানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। এই অগ্নিকাণ্ডের প্রথমত দায় দোকান মালিক সমিতির।  

অবশেষে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ভবনটি ভাঙার ও এই স্থানে দশতলা বহুতল ভবন করার জন্য উদ্যোগ নেয়। এই ব্যাপারে তারা দোকান মালিক সমিতির সহায়তা চায়। কিন্তু দোকান মালিক সমিতির বাধার মুখে  বাধার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ টিনের ভবনগুলো ভেঙে নতুন করে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। দোকান মালিকদের প্রণোদনা ও ভবন তৈরির সময়ে অন্য কোথাও বসার ব্যবস্থাও মেনে নেয়নি দোকান মালিক সমিতি। তারা এই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার মধ্যেই ব্যবসা চালিয়ে যেতে থাকে।  

সিটি কর্পোরেশন বসে থাকে নি। সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনের সময়ে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সটিকে স্টিলের অবকাঠামো দিয়ে ১০ তলা করতে দরপত্র আহ্বান করা হয়। এই কাজ করতে ঠিকাদারকে কার্যাদেশও (ভবন নির্মাণের অনুমতিপত্র) দেওয়া হয়েছিল। সিটি কর্পোরেশনের অগ্রগতি ঠেকাতে দোকান মালিক সমিতির নেতারা উচ্চ আদালতে গিয়ে নির্মাণকাজের স্থগিতাদেশ নিয়ে আসেন। এই অগ্নিকান্ডের দ্বিতীয়ত দায় উচ্চ আদালত তথা হাইকোর্টের। ফায়ার সার্ভিসের উচ্চঝুঁকি ঘোষিত মার্কেটে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি মালিক সমিতিকে দেয় হাইকোর্ট। 

সিটি কর্পোরেশন আপাত দৃষ্টিতে দমে যায়। এবার সিটি কর্পোরেশন, সরকার, ফায়ার সার্ভিস একজোট হয়ে ভিন্ন চিন্তা করে। আর এই ভিন্ন চিন্তা হলো বরাবরের মতো একটি পরিকল্পিত দুর্ঘটনা ঘটিয়ে দেওয়া। এটা হুট করে হবে না। বরং সরকার যখন কোনো ইস্যুতে বেকায়দা অবস্থায় থাকবে তখনই একটি দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বেকায়দা অবস্থা কাটিয়ে ওঠবে। অনির্বাচিত স্বৈরাচারী সরকার হলে যা হয়! দুই জন ব্যাক্তি মোটর সাইকেলযোগে এসে সকাল বেলা আগুন লাগিয়ে দিয়ে যায়। কাছে থাকা ফায়ার সার্ভির নির্লিপ্ত থাকে আগুনকে প্রশ্রয় দেয় যাতে পুরো মার্কেট পুড়ে ছাই হয়ে যায়।     

অগ্নিকাণ্ডের তৃতীয়ত কিন্তু প্রধান দায় সরকারের। এখানে সরকার বলতে শেখ হাসিনা, সিটি কর্পোরেশন ও ফায়ার সার্ভিস। তাদের নতুন ভবন করতে আর বাধা থাকলো না। যদিও নতুন ভবন করাটা যৌক্তিক কিন্তু তাদের উচ্ছেদ পলিসি অত্যন্ত ষড়যন্ত্রমূলক, হটকারী। এর মাধ্যমে হাজার হাজার ব্যবসায়ী অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।  

দোকান মালিক সমিতির কিছু নেতার ব্যক্তিগত স্বার্থ ও সুবিধা নেওয়ার মানসিকতা ও স্বৈরাচারী সরকারের নৃশংস পরিকল্পনায় হাজার হাজার পরিবার আজ পথে বসলো। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ঝুঁকিপূর্ণ, এটি বিবেচনায় নিয়েই সেখানে আধুনিক ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু যারা এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়াল, তারা সবাই কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত। কাজটি তারা করেছিল শুধু নিজেদের স্বার্থে, টাকার লোভে।

অগ্নিকাণ্ডের চতুর্থত ও পরোক্ষ দায় জার্মানভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম ডয়েচে ভেলের। সরকার পরিকল্পনা করে রেখেছিল যে কোনো সময় আগুন লাগাবে। কিন্তু সেই সময়টা এখন হতো না যদি DW র‍্যাব নিয়ে তাদের প্রতিবেদনটি পাবলিশ না করতো। DW র‍্যাবের নৃশংসতা নিয়ে তথ্যচিত্র পাবলিশ করলো। বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে হইচই লেগে গেল। অমনি স্বৈরাচারী হাসিনা ইস্যু ঢাকতে এখনই অগ্নিকাণ্ড লাগিয়ে দিল। ব্যবসায়ীরা তাদের সম্পূর্ণ অর্থ বিনিয়োগ করে ঈদের প্রাক্কালে পোশাক মজুদ করেছে। আর হাসিনা আগুন লাগিয়ে তা মুহূর্তেই ছাইয়ে পরিণত করলো। 

অগ্নিকাণ্ডের বেসিক দায় সরকারের মানে হাসিনার। আর এর বাইরে বঙ্গবাজার মালিক সমিতি, নালায়েক হাইকোর্টের বিচারকরাও কমদায়ী নয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন