হযরত আলী রা. যখন আবূ মূসা আশ'আরীকে প্রয়োজনীয় সৈন্যসহ দুমাতুল জানদালে শালিস করতে পাঠালেন তখন খারিজীরা তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি করে দেয়। তারা শালিসের এই বিষয়কে ইসলাম বিরুদ্ধ হিসেবে সাব্যস্ত করে। তারা আলী রা.-এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে এবং প্রকাশ্যভাবে তাকে কাফির বলে আখ্যায়িত করে।
আলী রা. ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের আন্দোলনকে বিনা বাধায় চালাতে দিয়েছেন যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের বিরুদ্ধ মতের মানুষের ওপর আঘাত না হেনেছে। আলী রা. তার ওপর আরোপিত সকল অভিযোগ খন্ডন করেছেন। ফলশ্রুতিতে তাদের প্রায় তিন ভাগের একভাগ নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে খারিজি মতামত প্রত্যাখ্যান করেছে।
তাদের মধ্য থেকে দুই ব্যক্তি যুর'আ এবং হারকূস আলী রা.-এর কাছে এসে বলতে লাগলেন, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারও হুকুম নেই। আলীও বললেন, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারও হুকুম নেই। হারকূস বললো, আপনি নিজের কৃত গুনাহ থেকে তওবা করুন এবং আমাদের সঙ্গে থেকে শত্রুর (মুয়াবিয়া রা.) বিরুদ্ধে জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করুন।
আলী রা. বললেন, আমি তো তোমাদের থেকে তাই চেয়েছিলাম কিন্তু তোমরাই তো অস্বীকার করলে। এখন তাদের ও আমাদের মধ্যে একটা লিখিত চুক্তিপত্র হয়েছে। আর চুক্তির ব্যাপারে মহান আল্লাহ্ ইরশাদ করেন,- তোমরা অংগীকার পূর্ণ করো যখন পরস্পর অংগীকার কর (নাহল : ৯১)।
হারকূস বললো, এ সালিশি চুক্তি একটি পাপ, এর থেকে আপনার তওবা করা উচিত। আলী রা. বললেন, এটি পাপ নয় বরং বলা যায় এটা একটি দুর্বল মত। আমরা মুসলিমদের রক্তপাত বন্ধ হোক তা চেয়েছি। যুরআ বললো, হে আলী! আপনি যদি সালিশ মানা ত্যাগ না করেন তাহলে আমরা আল্লাহর রহমত ও সন্তুষ্টি কামনায় আপনার বিরুদ্ধে লড়াই করবো। আলী বললেন, তুমি ধ্বংস হও! তুমি কি আমাকে লাশ মনে করেছো। মনে রেখ, তোমার দেহ মাটিতে আচ্ছন্ন হয়ে যাবে। যুরআ বললো, সেটাইতো আমার কাম্য।
আলী বললেন, তুমি যদি সঠিক পথের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে তাহলে দুনিয়া থেকে বিদায়কালে প্রশান্তি লাভ করতে। কিন্তু আফসোস! শয়তান যে তোমাদেরকে প্রতারণার জালে আবদ্ধ করে ফেলেছে। এরপর তারা উভয়ে সেখান থেকে দর্পভরে চলে যায় এবং জনগণের মধ্যে এসব কথা নিয়ে প্রচার প্রপাগান্ডা করতে থাকে। আলী রা. যখন মসজিদে খুতবা দিতে থাকেন তখন তারা শোরগোল করে খুতবায় বাধার সৃষ্টি করতো, গালাগাল দিতো এবং কুরআনের আয়াত পড়ে কটাক্ষ করতো। এখানে উল্লেখ্য যে, খারিজিরা প্রায় সবাই কুরআন মুখস্ত জানতো। কথায় কথায় কুরআনের দলিল দিতো। তাদেরকে অক্ষরবাদী বলা যায়। তারা কুরআনের শাব্দিক অর্থ গ্রহণ করতো। এজন্য আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন তারা কুরআন পাঠ করবে, কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালীর নিচে (অর্থাৎ অন্তরে) প্রবেশ করবে না।
খারিজীদের এ দলটি ভ্রান্তির ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো। কথায় ও কাজে তারা অত্যন্ত রুষ্ট ও রুক্ষ্ম। আলোচনা শেষে তারা ঐকমত্যে পৌঁছে যে, মুসলমানদের এ এলাকা ছেড়ে মাদাইন শহরে চলে যাবে। তাদের পরিকল্পনা হলো, মাদাইন শহর তারা দখল করে সেখানে নিরাপত্তা দুর্গ তৈরি করবে। সেখান থেকে বসরা ও অন্যান্য স্থানে তাদের মতাদর্শের যে সব লোকজন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তাদেরকে সংবাদ দিয়ে এখানে জড়ো করবে।
এই পরিকল্পনা যখন প্রায় চূড়ান্ত তখন যাইদ ইব্ন হাসান তাঈ বললো, তোমরা মাদাইন দখল করতে পারবে না, সেখানে দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী আছে। তাদেরকে তোমরা কিছুতেই পর্যুদস্ত করতে পারবে না। তারা তোমাদেরকে তাড়িয়ে দিবে। বরং আমার পরামর্শ হলো, তোমরা তোমাদের সকল সাথী বন্ধুদেরকে নাহরে জাওখার পুলের কাছে সমবেত হতে বলো। যাইদ আরও বললো, কুফা থেকে তোমরা দলবদ্ধভাবে বের হয়ো না; বরং একজন একজন করে হও। যাতে কেউ এই পরিকল্পনাটি বুঝতে না পারে। এ পরামর্শ সকলের পছন্দ হলো।
খারিজিরা বসরা ও অন্যান্য স্থানে তাদের অনুসারীদের নিকট পত্রসহ লোক পাঠালো যেন তারা দ্রুত নাহরে গিয়ে সমবেত হয়। এরপর তারা পর্যায়ক্রমে একে একে বের হয়ে যায়। কেউ যাতে তাদের উদ্দেশ্য জানতে পেরে বাধা দিতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখে। নিজেদের পিতা-মাতা, মামা-খালাসহ সকল পর্যায়ের আত্মীয়দের পশ্চাতে ফেলে এই সুধারণা নিয়ে তারা পৃথক হয়ে যায় যে, এর দ্বারাই আসমান যমীনের প্রতিপালক তাদের উপর সন্তুষ্ট হবেন। বস্তুত এটা ছিল তাদের চরম মূর্খতা এবং ইলম ও জ্ঞানের স্বল্পতারই পরিচায়ক।
খারিজিরা একত্রিত হয়ে ডাকাতি ও লুটপাট শুরু করে। এর মূল কারণ হলো তারা আলী রা.-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য রসদ জমা করতে চেয়েছিল। তারা সমাজে ফিতনা-ফ্যাসাদ বিস্তার করছে, খুন-রাহাজানিসহ নানা প্রকার হারাম কাজ করে চলছে। শুধু তাই নয়, তারা রাসূলুল্লাহ্ -এর সাহাবী আবদুল্লাহ ইব্ন খাব্বাবকেও তারা হত্যা করেছে।
বসরার নিকটবর্তী একটি গ্রামে হযরত খাব্বাব ইবনুল আরাত রা. এর পুত্র হযরত আব্দুল্লাহ রা. বসবাস করতেন। তিনি ছিলেন একজন আলেম ও মর্যাদাবান ব্যক্তিত্বের অধিকারী। নিয়মিত ডাকাতির অংশ হিসেবে খারেজিরা তাকে আটক করে কর্কশ ভাষায় জানতে চাইলো, কে তুমি? তিনি বললেন, আমি আল্লাহর রাসূলের সাহাবী হযরত খাব্বাবের পুত্র আব্দুল্লাহ। খারেজিদের সরদার বললো, মনে হচ্ছে আমরা আপনার মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছি? তিনি বললেন, হ্যাঁ সত্যিই।
খারেজিরা বললো, ভয়ের কিছু নেই। আমাদেরকে শুধু আল্লাহর রাসূলের কোনো একটি হাদীস শুনিয়ে দিন। আব্দুল্লাহ রা. বললেন, আমি আমার পিতার নিকট হতে শুনেছি, রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন, এমন একটি ফেতনা আসছে, যাতে বসে থাকা ব্যক্তি দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির থেকে উত্তম হবে। আর দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি হেঁটে চলা ব্যক্তির চেয়ে উত্তম হবে। যখন সেই ফেতনায় লিপ্ত লোকদের সম্মুখে পড়বে, তখন আল্লাহর নিহত বান্দা হয়ো, হত্যাকারী হয়া না।
খারেজিরা তখন বললো, আমরা এই হাদীসের ব্যাপারেই জানতে চেয়েছিলাম। আচ্ছা, আপনি আবু বকর ও ওমর রা. সম্পর্কে কি বলেন? আব্দুল্লাহ ইবনে খাব্বাব রা. তাদের প্রশংসা করলেন। খারেজিরা তখন বললো, উসমান রা. এর শাসনামলের প্রথম দিকের দিনগুলো কেমন ছিল? তখন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে খাব্বাব রা. বললেন, তিনি শুরুতেও সত্যের উপর ছিলেন এবং শেষেও সত্যের উপর ছিলেন। খারেজিরা তখন বললো, আলীর ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কি?
আব্দুল্লাহ ইবনে খাব্বাব রা. বললেন, আলী রা. দ্বীন সম্পর্কে অধিক অবগত। তিনি দ্বীনের ব্যাপারে অধিক সতর্ক ও দ্বীনের বাস্তবায়নকারী। এ কথা শুনে খারেজিরা ক্ষেপে গেল। তারা বলতে লাগলো, আরে তুমি তো নফসের গোলাম হয়ে গেছ। তুমি বিভিন্ন ব্যক্তির নামকে মাপকাঠি বানিয়ে নিয়েছ। কেউ অপরাধ করেছে এটা মনে হলেই খারিজিরা তাকে নফসের গোলাম বলে কাফির সাব্যস্ত করতো। তাকে হত্যা করা বৈধ মনে করতো।
তারা বললো, আল্লাহর কসম! তোমাকে এমনভাবে হত্যা করবো, যেভাবে আজ পর্যন্ত হয়তো কাউকে হত্যা করা হয় নি। এরপর খারেজিরা আব্দুল্লাহ রা. ও তার স্ত্রীকে নদীর তীর ধরে নিয়ে যেতে থাকে। যখন খারেজিরা আব্দুল্লাহ বিন খাব্বাব রা. ও তার স্ত্রীকে নিয়ে যেতে থাকে তখন তাদের সাথে করে এক অমুসলিমের শূকর যাচ্ছিল। এক খারেজি তরবারি দিয়ে সেটিকে মেরে ফেলে।
এই দৃশ্য দেখে তার সাথে থাকা এক খারেজি রেগে গিয়ে বলতে লাগলো, তুমি অমুসলিম অধিবাসীর শূকর হত্যা করেছ কেন? যখন সেখানে শূকরের মালিক আসলো। তারা তখন তাকে শূকরের মূল্য দিয়ে আপদ বিদায় করলো। হযরত আব্দুল্লাহ রা. এই ঘটনা দেখে ভাবলেন, তাদের মধ্যে হয়তো কিছুটা মানবতাবোধ আছে। তাই তিনি তাদেরকে বললেন, তোমাদেরকে আমি এই শূকরের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিষের নাম বলবো? খারেজিরা বললো, তা কি? তিনি তখন বললেন, আমার জীবন। আমি কখনো নামাজ কাজা করি নি। কখনো কোনো গুনাহ করি নি।
খারেজিরা তা শুনে মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইলো। একটু সামনে যাওয়ার পর একটি খেজুর গাছ চোখে পড়লো। তারা তখন আব্দুল্লাহ রহ. কে সেটার সাথে বাঁধলো। তখন সেই গাছ থেকে পড়ে যাওয়া খেজুর একজন খারেজি মুখে নিল। তখন সাথে সাথে অন্য খারেজি ব্যক্তি রেগে গিয়ে বললো, তুমি জিম্মি ব্যক্তির খেজুর কেন মুখে নিলে? মূল্য না দিয়ে তুমি এটা কি করে হালাল মনে করলে? শেষে বাধ্য হয়ে লোকটি মুখ থেকে খেজুর ফেলে দিল।
আব্দুল্লাহ রা. এই দৃশ্য দেখে বলতে লাগলেন, যদি তোমরা বাস্তবেই এতটা পরহেজগার হয়ে থাক, তাহলে তোমাদের থেকে আমার কোনো ভয় নেই। কিন্তু খারেজিরা তাদের ইচ্ছা পরিবর্তন করলো না। তারা আরো অগ্রসর হয়ে হযরত আব্দুল্লাহ বিন খাব্বাব রা. কে নদীর তীরে তরবারি দিয়ে হত্যা করলো।
আব্দুল্লাহ রা.-কে হত্যার পর খারেজিরা তার স্ত্রীকে হত্যা করতে উদ্যত হলো। তিনি তখন চিৎকার দিয়ে বলতে লাগলেন, “তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। আমি তো একজন নারী!” কিন্তু খারেজিদের পাষাণ হৃদয় গলনো না। তারা নির্মমভাবে তাকেও হত্যা করলো। এরপর পাষণ্ড খারেজিরা তাদের লাশ আগুনে পুড়িয়ে ফেললো। এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা দেখে এক খারেজি তওবা করে মুসলমানদের এই ঘটনা জানিয়ে দিল।
এই হৃদয়বিদারক ঘটনা আলী রা.-এর পৌঁছলে আলী রা. এবং মুসলিমরা ঘাবড়ে যায়। মুসলিমদের জান-মালের ব্যাপারে খারিজিদের মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখা হয়। বিষয়টা আলী রা.-এর জন্য খুবই উদ্বেগের খবর হিসেবে দেখা দেয়। এমনিতেই আলী রা. সংকটে ছিলেন কারণ সালিশ ব্যর্থ হয়। আমর রা. ও আবু মূসা রা. ঐক্যমতে পৌঁছতে পারেননি। এমতাবস্থায় খারিজিরা ডাকাতি, খুন ও রাহাজানি শুরু করেছিল।
আলী রা. শুরার সাথে পরামর্শ করে খারিজীদের বিরুদ্ধে মুকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নেন। আলী রা. নিজে অভিযান পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি সকলকে নিয়ে দু'রাকআত সালাত আদায় করেন। সালাত শেষ হলে তিনি যাত্রা আরম্ভ করেন। একটানা চলে প্রথমে পাদ্রী আবদুর রহমানের গির্জা এবং তারপরে পাদ্রী আবূ মূসার গির্জা অতিক্রম করে ফোরাত উপকূলে উপনীত হন। সেখানে এক জ্যোতিষীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়।
জ্যোতিষী হযরত আলী রা.-কে দিবসের একটি নির্দিষ্ট সময়ের উল্লেখ করে বলে ঠিক ঐ সময়ে আপনি যাত্রা করবেন। ঐ সময় ব্যতীত অন্য সময়ে যাত্রা করলে বিপদে পড়ার আশংকা আছে। কিন্তু আলী রা. জ্যোতিষীর প্রদর্শিত সময় বাদ দিয়ে ভিন্ন সময়ে যাত্রা করেন এবং আল্লাহ্ তাঁকে বিজয় দান করেন ।
এ প্রসঙ্গে আলী বলেন, আমি চেয়েছি লোকে যাতে বুঝতে পারে যে, জ্যোতিষীর বাণী ঠিক না। আমার আরও আশংকা ছিল যে, বিজয় হলে মূর্খ লোকেরা বলবে- জ্যোতিষীর বাণী অনুসরণ করায়ই বিজয় সম্ভব হয়েছে। হযরত আলী আম্বারের উপকণ্ঠে প্রবেশ করেন এবং কাইস ইব্ন সা'দকে সম্মুখে মাদাইন পাঠিয়ে দেন। তাকে মাদাইনের প্রশাসক সা'দ ইব্ন মাসউদ (আবদুল্লাহ ইবন মাসউদের ভাই)-এর সাথে সাক্ষাৎ করে মাদাইনের সৈন্যদের সাথে মিলিত হওয়ার সংবাদ দেওয়ার নির্দেশ দেন।
সকল দিক থেকে সৈন্যরা এসে আলী রা.-এর কাছে একত্রিত হয়। এখান থেকে তিনি খারিজীদের নিকট সংবাদ পাঠিয়ে জানান যে, তোমাদের যে সব লোক আমাদের ভাইদের হত্যা করেছে তাদেরকে আমাদের হাতে অর্পণ করো। আমরা তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দিব। এরপরে তোমাদের সাথে আমাদের আর কোন সংঘর্ষ নেই। আগের চুক্তি বহাল থাকবে।
এর জওয়াবে তারা আলী রা.-কে জানাল, আমরা সকলে মিলে তোমাদের ভাইদের হত্যা করেছি। শুধু তাই নয়, তাদের ও তোমাদের হত্যা করা ন্যায়সংগত বলে আমরা বিশ্বাস করি। তখন কাইস ইব্ন সা'দ অগ্রসর হয়ে তারা যে ভয়াবহ কাজে জড়িয়ে পড়েছে এবং যে মহা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে সে বিষয়ে তাদেরকে উপদেশ দিলেন। কিন্তু তার উপদেশে কোন কাজ হলো না । এরপর আবূ আইয়ূব আনসারীও তাদেরকে ভয়-ভীতি ও দুঃখময় সংবাদ শুনান। কিন্তু তার কথায়ও তাদেরকে প্রভাবিত করলো না।
এরপর আমীরুল মু'মিনীন আলী রা. তাদের কাছে গেলেন। তিনি তাদেরকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন। তারপর সাবধান করলেন, সতর্কবাণী উচ্চারণ করলেন, ভয় দেখালেন ও ভীতি প্রদর্শন করলেন। তারপরে বললেন, তোমরা এমন একটি বিষয়ে আমার উপর অসন্তুষ্টি প্রকাশ করছো, যে বিষয়ের দিকে তোমরাই আমাকে আহ্বান জানিয়েছিলে আর আমি তা করতে তোমাদেরকে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু তোমরা তা গ্রহণ করনি।
কেননা তোমাদের প্রবৃত্তি এমন একটি বিষয়কে তোমাদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে যার উপর ভিত্তি করে তোমরা মুসলমানদের হত্যা করছো। আল্লাহ কসম! ঐ যুক্তিতে যদি একটি মুরগীও হত্যা কর সেটিও মহান আল্লাহ নিকট মহাপাপ হিসেবেই গণ্য হবে। মুসলমানদের হত্যা করা তো অনেক দূরের ব্যাপার। এ কথার কোন জওয়াব তারা দিতে পারেনি। বরং তাদের লোকদের জানিয়ে দিল যে, ওদের সাথে কোন আলোচনা করো না, কোন কথা বলো না। তার বদলে মহান আল্লাহর দিদার লাভের জন্যে প্রস্তুত হয়ে যাও। চলো চলো, জান্নাতের দিকে চলো। তারা অগ্রসর হয়ে যুদ্ধের জন্যে সারিবদ্ধ হলো এবং হামলা করার প্রস্তুতি নিল। আলী রা. ও তাঁর সংগীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার উদ্দেশ্যে তারা পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়।
অপরদিকে হযরত আলী রা. তাঁর সৈন্য বাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেন। আবু আইয়ুব আনসারী রা.-কে দিয়ে একটি নিরাপত্তা পতাকা স্থাপন করেন এবং খারিজীদের উদ্দেশ্যে এই ঘোষণা দিতে বলেন যে, যারা এই পতাকার নিচে এসে দাঁড়াবে তারা নিরাপদ। যারা কুফা অথবা মাদাইনে চলে যাবে তারাও নিরাপদ। তোমাদের মধ্যে যারা আমাদের ভাইদের হত্যা করেছে তারা ছাড়া অন্য কারও সাথে যুদ্ধ করার আমাদের প্রয়োজন নেই। এ ঘোষণা দেওয়ার পর খারিজীদের মধ্য হতে বহু সংখ্যক লোক ফিরে আসে। বাকীরা আলী রা.-এর দিকে অগ্রসর হলো। তখন আলী তার অশ্বারোহী বাহিনীকে সম্মুখে রাখলেন, তাদের কাছে রাখলেন তীরন্দাজ বাহিনী আর পদাতিক বাহিনী রাখলেন অশ্বারোহীদের পশ্চাতে, এরপর তিনি তাঁর সৈন্য বাহিনীকে নির্দেশ দিলেন, ওরা . তোমাদের উপর হামলা শুরু না করা পর্যন্ত তোমরা সংযত থাকবে।
খারিজিরা তাকবির ধ্বনি দিয়ে আক্রমণ চালালো। তীরন্দাজ বাহিনী তাদের মুকাবিলা করলো। এরা তাদের মুখের উপর তীর ছুঁড়তে লাগলো। পদাতিক বাহিনীও বর্শা ও তলোয়ার নিয়ে দ্রুত ঝাঁপিয়ে পড়লো। এভাবে ত্রিমুখী আক্রমণ চালিয়ে খারিজীদের সমূলে বিনাশ করে দেয়। তাদের মৃতদেহগুলো অশ্বের খুরের নিচে পড়ে থাকে। যুদ্ধে খারিজীদের নেতৃবৃন্দ যথা : আবদুল্লাহ্ ইব্ন ওহাব, হারকূস ইবন যুহাইর, শুরাইহ্ ইবন আওফা ও আবদুল্লাহ্ ইব্ন সাখবুরাহ্ সুলামী সবাই নিহত হয়। এ যুদ্ধে আলীর দলের মাত্র সাত ব্যক্তি শহীদ হন।
যুদ্ধ শেষে আলী শত্রুদের লাশের ভিতর দিয়ে হেঁটে যান এবং বলেন ধিক তোমাদের! সে-ই তোমাদের ক্ষতির মধ্যে ফেলেছে, যে তোমাদের ধোঁকা দিয়েছে। সাথীরা জিজ্ঞেস করলো, আমীরুল মু'মিনীন! কে তাদেরকে ধোঁকা দিয়েছে? তিনি বললেন, শয়তান ও নফসে আম্মারা(কুপ্রবৃত্তি)। এগুলো এদেরকে ভবিষ্যতের মিথ্যা আশা দিয়ে প্রতারিত করেছে এবং পাপ কাজকে আকর্ষণীয় পুণ্যের কাজ হিসেবে দেখিয়েছে এবং এরাই বিজয় লাভ করবে বলে সুসংবাদে মাতিয়ে রেখেছে। শত্রুদের থেকে প্রাপ্ত অস্ত্র ও আসবাবপত্র হযরত আলী রা. সৈন্যদের মধ্যে বণ্টন করে দেন।
ইউনুস ইব্ন আবূ ইসহাক ইসমাঈলের সূত্রে হুব্বাতুল উরানী থেকে বর্ণনা করেন যে, নাহরাওয়ানের যুদ্ধ শেষে সৈন্যরা যখন ফিরে আসছিল তখন লোকজন বলতে লাগলো, হে আমীরুল মু'মিনীন! সেই আল্লাহর প্রশংসা যিনি খারিজীদের মূলোৎপাটন করে দিয়েছেন। তিনি বললেন, কখনও না, আল্লাহর কসম! তারা অবশ্যই পুরুষ লোকের পৃষ্ঠদেশে এবং মেয়ে লোকের রেহেমে বিদ্যমান আছে। যখন এ দুই ধারা থেকে তারা বেরিয়ে আসবে তখন যার সাথেই তার সাক্ষাৎ হবে তার উপর প্রাধান্য বিস্তারের জন্যে সে ফিৎনা সৃষ্টি করতে থাকবে— এর ব্যতিক্রম হবে না ।
খারিজিরা খুব বেশি ইবাদত করতো। ইউনুস রহ. আরো বলেন, আবদুল্লাহ্ ইবন ওহাব রাসিবী, এতো অধিক ইবাদত ও সিজদা করতো যে, তার সিজদার স্থানসমূহের চামড়া শুকিয়ে গিয়েছিল। লোকে তাঁকে ফুল-বায়্যিনাত উপাধিতে ভূষিত করে। আলীর কাছে জিজ্ঞেস করা হয় যে, খারিজীরা মুশরিক কি না? তিনি বললেন, শির্ক থেকে বাঁচার জন্যেই তো তারা আলাদা হয়েছে। জিজ্ঞেস করা হলো, তা হলে কি তারা মুনাফিক ? তিনি বললেন, - মুনাফিকরা আল্লাহর ইবাদত খুব কমই করে থাকে। আবার জিজ্ঞেস করা হলো, হে আমীরুল মু'মিনীন! তবে তাদের অবস্থানটা কি? আলী রা. বললেন, তারা আমাদের ভাই। আমাদের বিরুদ্ধে ওরা বিদ্রোহ করেছে, হত্যা করেছে। সেই বিদ্রোহের কারণেই আমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়েছি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন