বড় কঠিন ছিল সেই পরিক্ষা। স্ত্রী ও নবজাতক সন্তানকে রেখে যেতে হয়েছে দুই হাজার কিলোমিটার দূরে। জনমানবহীন মরুভূমিতে। বলছি ইবরাহীম আ.-এর কথা। জগতের সব কঠিন পরিক্ষা দিতে হয়েছে তাঁকে। তিনি নমরুদের আগুন থেকে আল্লাহর ইশারায় রক্ষা পেলেও নমরুদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারেন নি।
নমরুদ তাঁকে দেশত্যাগে বাধ্য করেছিল। এরপর ফিলিস্তিন, মিশর, আরব ইত্যাদি দেশ ঘুরে সিরিয়ায় থিতু হলেন। তাঁর জীবন জুড়েই পরীক্ষা। আমরা সবাই কমবেশি এই সম্পর্কে জানি। তিনি তাঁর ২য় স্ত্রী ও সন্তান ইসমাঈল আ.-কে মক্কায় রেখে গেলেন।
ধীরে ধীরে সেখানে বসতি তৈরি হলো। ইসমাঈল আ. নবুয়্যত প্রাপ্ত হলেন। আরবে ঘুরে ঘুরে জনমানুষের কাছে তাওহীদের দাওয়াত পৌঁছে দিচ্ছেন। এমনই এক দিনে ইবরাহীম আ. তাঁর বড় সন্তান ইসমাঈল আ.-এর সাথে দেখা করতে সিরিয়া থেকে মক্কায় এলেন।
এখানে এসে তিনি দেখেন হযরত ইসমাঈল আ. বাড়িতে নেই।
পুত্রবধূকে জিজ্ঞেস করেন- সে কোথায় গেছে?
- তিনি পানাহারের খোঁজে বেরিয়েছেন। অর্থাৎ শিকারে গেছেন।
- তোমাদের অবস্থা কি?
- অবস্থা খারাপ, বড়ই দারিদ্র্য ও সংকীর্ণতার মধ্যে দিন যাপন করছি।
- তোমার স্বামী বাড়ী আসলে তাকে আমার সালাম জানাবে এবং বলবে সে যেন তার দরজার চৌকাঠ পরিবর্তন করে।
ইসমাঈল আ. ফিরে এসে যেন তিনি কোনো মেহমানের আগমনের ইঙ্গিত পেয়েছেন। তাঁর স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন,
- এখানে কোন লোকের আগমন ঘটেছিল কি?
স্ত্রী বলে, হ্যাঁ, এরূপ এরূপ আকৃতির একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এসেছিলেন। তিনি আপনার সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলে আমি বলি যে, তিনি শিকারের অনসুন্ধানে বেরিয়েছেন।
- আমাকে কিছু বলতে বলেছেন কি?
- হ্যাঁ, বলেছেন যখন তোমার স্বামী আসবে তখন তাকে বলবে যে, সে যেন তার দরজার চৌকাঠ পরিবর্তন করে।
হযরত ইসমাঈল আ. তখন বলেন, হে আমার সহধর্মিনী! জেনে রেখো যে, উনি আমার আব্বা ইবরাহীম আ.।
ইসমাঈল আ. বুঝে নিলেন, ইবরাহীম আ. তাঁকে এই স্ত্রী পরিত্যাগ করার জন্য বলেছেন। তিনি স্ত্রীকে সসম্মানে বিদায় দিলেন ও কষ্ট থেকে মুক্তি দিলেন। অতঃপর ঐ গোত্র থেকেই আরেকজন নারীকে বিবাহ করলেন।
কিছুদিন পর ইবরাহীম আ. পুনরায় মক্কায় আসেন। ঘটনাক্রমে এবারও হযরত ইসমাঈল আ.-এর সাথে সাক্ষাৎ হয়নি। পুত্রবধূকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন যে, তিনি তাদের জন্যে আহার্যের অনুসন্ধানে বেরিয়েছেন।
পুত্রবধূ বলে, আপনি বসুন। বিশ্রাম করুন ও সামান্য কিছু আহার করুন।
তিনি জিজ্ঞেস করেন, তোমাদের দিন যাপন কীভাবে হচ্ছে এবং তোমাদের অবস্থা কীরূপ?
- আলহামদুলিল্লাহ! আমরা ভালোই আছি এবং আল্লাহর অনুগ্রহে সুখে-স্বচ্ছন্দে আমাদের দিন যাপন হচ্ছে। এজন্য আমরা মহান আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
- তোমাদের কী খাও?
- গোশত।
- তোমরা কী পান করো?
- পানি।
- হে আল্লাহ! আপনি তাদের গোশত ও পানিতে বরকত দিন।
(এই ঘটনার প্রেক্ষিতে রাসূল সা. বলেন, যদি ইসমাঈল আ.-এর বাসায় শস্য থাকতো এবং তারা এটা বলতো। তবে ইবরাহীম আ. তাদের জন্যে শস্যেরও বরকত চাইতেন। এখন এই প্রার্থনার বরকতে মক্কাবাসী শুধুমাত্র গোশত ও পানির উপরেই দিনযাপন করতে পারে, অন্য লোক পারে না।)
অতঃপর ইবরাহীম আ. বলেন, আচ্ছা, আমি যাচ্ছি, তোমার স্বামীকে আমার সালাম জানাবে এবং বলবে সে যেন তার চৌকাঠ ঠিক রাখে।
এরপর ইসমাঈল আ. এসে সমস্ত সংবাদ অবগত হন। তিনি বলেন, উনি আমার সম্মানিত আব্বা ছিলেন। আমাকে নির্দেশ দিয়ে গেছেন যে, আমি যেন তোমাকে পৃথক না করি।
আবার কিছু দিন পর ইবরাহীম আ. সিরিয়া থেকে মক্কায় এলেন। ইসমাঈল আ. তখন যমযম কূপের পাশে একটি পাহাড়ের উপর তীর সোজা করছিলেন। এমতাবস্থায় তাঁদের দেখা হয়। তাঁরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেন।
ইবরাহীম আ. বলেন, হে ইসমাঈল! আমার প্রতি আল্লাহ তা'আলার একটি নির্দেশ হয়েছে।
- যে নির্দেশ হয়েছে তা পালন করুন আব্বা।
- তোমাকেও আমার সাথে থাকতে হবে।
- আমি প্রস্তুত আছি আব্বা!
- এই স্থানে আল্লাহ তা'আলার একটি ঘর নির্মাণ করতে হবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার, কা'বা প্রথমেই ইবরাহীম আ. দ্বারা প্রস্তুত হয়নি। বায়তুল্লাহ প্রথমে ফেরেশতাগণ নির্মাণ করেন। অতঃপর হযরত আদম আ. পুনর্নিমাণ করেন। তারপর নূহ আ.-এর সময় মহাপ্লাবণে বায়তুল্লাহর প্রাচীর বিনষ্ট হলেও ভিত্তি আগের মতই থেকে যায়।
পরবর্তীতে আল্লাহর হুকুমে একই ভিত্তিভূমিতে ইবরাহীম তা পুনঃনির্মাণ করেন। এই নির্মাণকালে ইবরাহীম আ. মক্কায় এসে বসবাস করেন ও বাপ-বেটা মিলেই কা'বা গৃহ নির্মাণ করেন। আল্লাহর ইচ্ছায় তখন থেকে অদ্যাবধি কা'বা গৃহে অবিরত ধারায় হজ্জ ও তাওয়াফ চালু আছে।
আল্লাহ বলেন,
আর যখন আমরা ইবরাহীমকে বায়তুল্লাহর স্থান ঠিক করে দিয়ে বলেছিলাম যে, আমার সাথে কাউকে শরীক করো না এবং আমার গৃহকে পবিত্র রাখো তাওয়াফকারীদের জন্য, নামাজে দন্ডায়মানদের জন্য ও রুকূ-সিজদাকারীদের জন্য। (সূরা হজ্জ -২৬)।
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন,
আর তুমি মানুষের মধ্যে হজ্জের ঘোষণা জারি করে দাও। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সর্বপ্রকার কৃশকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত হতে। যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থান পর্যন্ত পৌঁছে যায় এবং (কুরবানীর) নির্দিষ্ট দিনগুলিতে (১০, ১১, ১২ই যিলহাজ্জ) তাঁর দেওয়া চতুষ্পদ পশু সমূহ যবেহ করার সময় তাদের উপরে আল্লাহর নাম স্মরণ করে। অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং আহার করাও অভাবী ও দুস্থদেরকে। (সূরা হজ্জ ২৭-২৮)।
উপরোক্ত আয়াতগুলিতে কয়েকটি বিষয় জানা যায়। যেমন- (১) বায়তুল্লাহ ও তার সন্নিকটে কোনরূপ শিরক করা চলবে না (২) এটি স্রেফ তাওয়াফকারী ও আল্লাহর ইবাদতকারীদের জন্য নির্দিষ্ট হবে (৩) এখানে কেবল মুমিন সম্প্রদায়কে হজ্জের আদেশ দেওয়া হয়েছে।
কা'বা তৈরি হয়ে গেলে ইবরাহীম আ. মাক্বামে ইবরাহীমে দাঁড়িয়ে এবং কোন কোন বর্ণনা মতে আবু কুবায়েস পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে দুই কানে আঙ্গুল দিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে উচ্চ কণ্ঠে চারদিকে ফিরে বারবার হজ্জের উক্ত ঘোষণা জারি করেন।
ইবরাহীম আ. উক্ত ঘোষণা আল্লাহ পাক সাথে সাথে বিশ্বের সকল প্রান্তে মানুষের কানে কানে পৌঁছে দেন। ইবনু আব্বাস রা. বলেন, ইবরাহীমী আহবানের জওয়াবই হচ্ছে হাজীদের লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক।
সেদিন থেকেই কা'বাকে কেন্দ্র করে হজ্জ ও কুরবানীর বিধান মানব ইতিহাসে যুক্ত হয়ে গেল। এক কালের চাষাবাদহীন বিজন পাহাড়ী উপত্যকা ইবরাহীম আ.-এর দোয়া বরকতে হয়ে উঠলো বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের সম্মিলনস্থল হিসাবে।
যেমন আল্লাহ বলেন,
যখন আমরা কা'বা গৃহকে লোকদের জন্য সম্মিলনস্থল ও নিরাপদস্থলে পরিণত করলাম (আর বললাম,) তোমরা ইবরাহীমের দাঁড়ানোর স্থানটিকে সালাতের স্থান হিসাবে গ্রহণ করো। অতঃপর আমরা ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, ইতেকাফকারী ও রুকূ-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র করো। (বাক্বারাহ ১২৫)।
কা'বা ঘর প্রস্তুত ও হজ্জ্বের ঘোষণা দেওয়ার পর পিতা-পুত্র দুইজনে আল্লাহর কাছে হাত তুললেন এবং কতকগুলো দোয়া করতে থাকলেন।
১. হে আমার রব! এই শহরকে শান্তি ও নিরাপত্তার শহর বানিয়ে দাও। আর এর অধিবাসীদের মধ্য থেকে যারা আল্লাহ ও আখেরাতকে মানবে তাদেরকে সব রকমের ফলের আহার্য দান করো। -বাক্বারাহ ১২৬
২. হে আমাদের রব! আমাদের এই খিদমত কবুল করে নাও। তুমি সবকিছু শ্রবণকারী ও সবকিছু জ্ঞাত। -বাক্বারাহ ১২৭
৩. হে আমাদের রব! আমাদের দু'জনকে তোমার মুসলিম (নির্দেশের অনুগত) বানিয়ে দাও। আমাদের বংশ থেকে এমন একটি জাতির সৃষ্টি করো যে হবে তোমার মুসলিম। তোমার ইবাদাতের পদ্ধতি আমাদের বলে দাও এবং আমাদের ভুলত্রুটি মাফ করে দাও। তুমি বড়ই ক্ষমাশীল ও অনুগ্রহকারী। -বাক্বারাহ ১২৮
৪. হে আমাদের রব! তুমি এদের মধ্য থেকেই এদের নিকটে একজন রাসূল প্রেরণ কর, যিনি তাদের নিকটে এসে তোমার আয়াতসমূহ পাঠ করে শুনাবেন, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবেন এবং তাদের পবিত্র করবেন। নিশ্চয়ই তুমি পরাক্রমশালী ও দূরদৃষ্টিময়। -বাক্বারাহ ১২৯
৫. হে আমার রব! এ শহরকে নিরাপত্তার শহরে পরিণত করো এবং আমাকে ও আমার সন্তানদেরকে মূর্তিপূজা থেকে বাঁচাও। -ইবরাহিম ৩৫
৬. হে আমার রব! এ মূর্তিগুলো অনেককে ভ্রষ্টতার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে, যে আমার পথে চলবে সে আমার অন্তর্গত আর যে আমার বিপরীত পথ অবলম্বন করবে, সে ক্ষেত্রে অবশ্যই তুমি ক্ষমাশীল ও মেহেরবান। -ইবরাহিম ৩৬
৭. হে আমাদের রব! আমি একটি তৃণ পানিহীন উপত্যকায় নিজের বংশধরদের একটি অংশকে তোমার পবিত্র গৃহের কাছে এনে বসবাস করিয়েছি। পরওয়ারদিগার! এটা আমি এ জন্য করেছি যে, এরা এখানে নামায কায়েম করবে। কাজেই তুমি লোকদের মনকে এদের প্রতি আকৃষ্ট করো এবং ফলাদি দিয়ে এদের আহারের ব্যবস্থা করো, হয়তো এরা শোকরগুজার হবে। -ইবরাহিম ৩৭
৮. হে আমার রব! আমাকে নামায কায়েমকারী বানাও এবং আমার বংশধরদের থেকেও। হে আমাদের রব আমার দোয়া কবুল করো। -ইবরাহিম ৪০।
ইবরাহীম ও ইসমাঈলের উপরোক্ত দোআগুলো আল্লাহ কবুল করেছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে তাদের বংশে চিরকাল একদল মুত্তাকী পরহেযগার মানুষের অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। তাঁদের পরের সকল নবী তাঁদের বংশধর ছিলেন। কা'বার খাদেম হিসাবেও চিরকাল তাদের বংশের একদল দ্বীনদার লোক সর্বদা নিয়োজিত ছিল। কা'বার খেদমতের কারণেই তাদের সম্মান ও মর্যাদা সারা আরবে এমনকি আরবের বাইরেও বিস্তার লাভ করেছিল।
নিজের জন্য, নিজ শহরের জন্য, জনপদের জন্য, নিজের বংশধরদের জন্য এমন সুন্দর দোয়া ইবরাহীম আ. করেছিলেন। আল্লাহ তায়ালা এই দুয়াগুলোকে পছন্দ করেছেন। তাই কুরআনে দু'আগুলোকে উদ্ধৃত করে দিয়েছেন।
আমরা নিজের জন্য, নিজের দেশের জন্য ও নিজের সন্তানদের এই দুয়াগুলো করতে পারি।
ভালো হয় রব্বানা ও রব্বি দিয়ে শুরু হওয়া দোয়াগুলো মুখস্ত করতে পারলে।
#রব্বানা
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন