প্রতিষ্ঠার পর থেকে ষাটের দশকে ছাত্র ইসলামী আন্দোলন একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল। লোক সংগ্রহ, সংগঠন কায়েম, সংগঠনকে পরিচিতকরণ। ইত্যাদি কার্যক্রমেই বেশি দৃষ্টি দেওয়া হয়। ঐসময়ে যারা কাজ করছিলেন তারা ছাত্র সংগ্রহের জন্য স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসায় বিরাহীনভাবে কাজ চালিয়ে যান। একজন দুইজন করে বাড়তে থাকে।
ষাটের দশকে মূলধারার রাজনীতির সাথে ছাত্র ইসলামী ছাত্র সংঘ তথা জমিয়তে তলাবার সম্পর্ক ছিল না। জমিয়তে তলাবা শুধুমাত্র ছাত্রদেরকে একটি ইসলামী সমাজ গঠনের দিকে আহবান জানাতে থাকে। রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশ নেওয়ার মতো শক্তি হয়নি বিধায় তারা তখন সেদিকে শক্তি ব্যয় করেনি। তবে দেশের রাজনীতি সম্পর্কে অবশ্যই সচেতন করার প্রায়াস ছিল।
ষাটের দশকে ছাত্র-রাজনীতি, ছাত্র সংসদ নির্বাচনের অবস্থা এখনকার মতো খারাপ ছিল না। অনেকটা গঠনমূলক বলা চলে। তারপরও ছাত্র-ইসলামী ছাত্রসংঘ ছাত্র-সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় নি। পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন করেছে বলা চলে। জামায়াতের নেতৃত্বে অন্যান্য ইসলামী দলের আন্দোলনের ফলে পাকিস্তান সাংবিধানিকভাবে সেক্যুলার না হয়ে 'ইসলামিক রিপাবলিক' হয়। এর ফলে ইসলামী জমিয়তে তলাবার মূল আন্দোলন ছিল শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তনের আন্দোলন।
ব্রিটিশ বেনিয়াদের প্রচলিত সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার পক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচারণা চালিয়েছে জমিয়তে তলাবা। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতি চিহ্নিত করে আন্দোলনের জনশক্তির সচেতন করেছে। অপরদিকে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জনশক্তিকে জ্ঞানদান করা হয়েছে। ইসলামী জমিয়তে তলাবার এটাই ছিল বড় রাজনৈতিক এজেন্ডা। এই ইস্যুতে ঢাকা ভার্সিটিতে প্রায়ই সভা ও সেমিনার করতো জমিয়তে তলাবা।
ষাটের দশকের পর্যায়টি ছিল সংগঠনের ভিত্তি গড়া, পরিচিতিকরণ ইত্যাদি প্রস্তুতিমূলক কাজ। যাত্রা শুরু হয়েছিল মাত্র। শক্তিশালী আন্দোলন হিসেবে পরিচিত হওয়া বা স্বীকৃতি লাভ করার পর্যায় তখন ছিল না। তাই প্রতিপক্ষ শক্তিগুলো ছাত্র ইসলামী আন্দোলনকে বুঝে উঠতে পারেনি। যদিও কিছু কিছু বামপন্থী নেতা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। সার্বিকভাবে প্রতিপক্ষ শক্তিগুলো ছাত্র ইসলামী আন্দোলনকে অনেকটা উপেক্ষা করেই চলছিল। ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ, ঠাট্টা, উপহাসের মধ্যে তাদের বিরোধিতা সীমাবদ্ধ ছিল বলে মনে হয়েছে।
১৯৬৫ সালের পরে বর্তমান বাংলাদেশ ছিল আন্দোলনে উত্তাল। সেসময় ইসলামী ছাত্রসংঘকে তিনটি শক্তিকে মোকাবিলা করতে হয়েছে।
১। স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের গুন্ডা সংগঠন এনএসএফ। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গুন্ডামী করাই ছিল তাদের কাজ। এখন ছাত্রলীগ যেমন।
২। আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। এনএসএফের বিরোধীতার নামে ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা ছিল তাদের কাজ। রাষ্ট্রীয় সংহতি নষ্ট করে বিভিন্ন ইস্যুতে দাঙ্গা লাগানো ছিল তাদের কাজ। গুন্ডামীতে তারাও পিছিয়ে ছিল না।
৩। নাস্তিক্যবাদী বাম সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন। কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠার নামে ধর্মবিরোধীতা ছিল তাদের কাজ। ইসলামী জমিয়তে তলাবাকে তাদের সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই করতে হয়েছে।
ছাত্র রাজনীতিতে এ সময় বামদের প্রাধান্য যথেষ্ট ছিল। গোটা পরিবেশটা ছিল প্রতিকূলের এবং ক্রমান্বয়ে তা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছিল। এ পরিস্থিতিতে ইসলামী জমিয়তে তলাবাকে তার পথ রচনা করতে হচ্ছিল। যা ছিল পাহাড় অপসারণ করার মত এক দুরূহ কাজ। সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে সুষ্ঠু সুন্দর পরিকল্পনা সামনে রেখে অত্যন্ত ধৈর্যসহ ছাত্র ইসলামী আন্দোলনের কাজ এগিয়ে চলছিল।
ঐ সময় আত্মগঠন, জনশক্তির মান উন্নয়নমূলক কাজকে খুবই গুরুত্ব দেয়া হতো। বন্ধ সৃষ্টি, গ্রুপ ভিত্তিক দাওয়াতী কাজ, ব্যক্তিগত দাওয়াত, সামষ্টিক দাওয়াত, ব্যক্তিগত রিপোর্ট সংরক্ষণ ও পর্যালোচনা, সাপ্তাহিক বৈঠক, মাসিক বৈঠক, সাংগঠনিক রিপোর্ট, সামষ্টিক পাঠ, পাঠচক্র, শববেদারী, শিক্ষা বৈঠক, শিক্ষাশিবির ইত্যাদি কাজগুলোকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হতো। ব্যক্তিগত অধ্যয়ন, নামাজসহ ইবাদাত বন্দেগীর মান উন্নয়নে সবিশেষ নজর দেয়া হতো। সত্যিকার অর্থেই ইসলামী ধ্যান-ধারণা অনুযায়ী চরিত্র গঠিত হচ্ছে কিনা তা গভীরভাবে মূল্যায়ন করা হতো। বক্তৃতার ভাষা, কবিতার ছন্দ, প্রবন্ধের বিষয় ও উপস্থাপনা ইসলামের ধ্যান-ধারণা অনুযায়ী হচ্ছে কিনা তার প্রতি খুবই নজর দেয়া হতো। কথা ও কাজের মিল না হলে যত বড় ব্যক্তিই হন না কেন দায়িত্ব দেয়া হতো না।
ইসলামী জমিয়তে তলাবার পূর্ব পাকিস্তান অংশের সভাপতি যারা ছিলেন,
১. খাজা মাহবুব এলাহী, ১ম প্রাদেশিক সভাপতি (১৯৫৫-১৯৫৭)
২. সাইয়্যেদ মুহাম্মদ আলী (১৯৫৮-১৯৬০)
৩. হাবিবুর রহমান (১৯৬১-১৯৬২)
৪. এ বি এম নাজিম (১৯৬৩)
৫. এ কে এম নাজির আহমদ (১৯৬৪-১৯৬৫)
৬. গোলাম সারোয়ার (১৯৬৬-১৯৬৭)
৭. শহীদ মতিউর রহমান নিজামী (১৯৬৮)
৮. মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম (১৯৬৯)
৯. শহীদ আলী আহসান মু. মুজাহিদ (১৯৭০-১৯৭২)
১০. আবু নাসের মু. আব্দুজ জাহের (১৯৭৩-১৯৭৬)
খাজা মাহবুবে এলাহীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এদেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইসলামী ছাত্র সংঘ কমিটি গঠন করতে থাকে। প্রায় দশ বছর পর একেএম নাজির আহমেদের সময় দেখা যায় জনশক্তির সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়িয়ে যায়। দশ বছরে এটা ছিল বিস্ময়কর অগ্রগতি। প্রতিষ্ঠার ছয় বছর পর আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু হয় পূর্ব পাকিস্তানে। কিন্তু কর্মী বৃদ্ধির দিক থেকে ১৯৬৫ সালে সমান সমান হয়ে যায়। এটা ছিল এখানকার আল্লাহর সাহায্য ও দা'য়ীদের একনিষ্ঠ প্রচেষ্টার ফল।
ইসলামী ছাত্রসংঘের এই অঞ্চলের সভাপতি একেএম নাজির আহমদ দেখলেন প্রচুর রফিক (বর্তমান নাম সাথী) তৈরি হওয়ায় তাদের মান সংরক্ষন হচ্ছে না। তখন তিন হাজারের বেশি রফিক ছিল। এসব রফিকদের অনেকে ৩ বছরের অধিক সময় ধরে রফিক কিন্তু তারা রুকন (বর্তমান নাম সদস্য) হচ্ছে না।
তাই রফিকদের মানোন্নয়নের জন্য এক ব্যতিক্রমধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। ইসলামী ছাত্রসংঘ বেশিরভাগ সাথীর সাথী পদ বাতিল করে। সকলকে একটা নির্দিষ্ট সময় দেওয়া হয় নির্দিষ্ট মানে পৌঁছার জন্য। ঐ সময়ের মধ্যে যারা মানে পৌঁছতে সক্ষম হন তাদেরকেই শুধু সাথী করা হয়। যার সংখ্যা চারশতের অধিক হবে না। অর্থাৎ এ পদক্ষেপের ফলে সাথী সংখ্যা কয়েক হাজারের কোটা থেকে কয়েক শতকে এসে দাঁড়ায়।
পূর্বের তুলনায় কম সংখ্যায় হলেও নতুন সাথীদের মান উন্নত হওয়ার কারণে ছাত্র ইসলামী আন্দোলনে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। সকলেই মানের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। নিজ নিজ মান বৃদ্ধিতে যত্নবান হয়ে ওঠেন। ফলে ছাত্র মহলে ইসলামী ছাত্র সংঘের চারিত্রিক প্রভাব অনেকগুণ বৃদ্ধি পায়। শক্ত মেরুদণ্ডের ওপর আন্দোলনের অবকাঠামো দাঁড়িয়ে যায়।
পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ইসলামী ছাত্রসংঘ কাজ করে যাচ্ছিল। এটা অনেকেই বিশেষ করে বামপন্থী সংগঠনগুলো বরদাশত করতে পারছিল না। যারা এই বিষয় বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ ও জনমত গঠন করছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বগুড়ার মানুষ ঢাকা ভার্সিটির ছাত্র ও ইসলামী ছাত্রসংঘের ঢাকা শহরের নেতা আব্দুল মালেক। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আয়োজিত একটি সেমিনারে ক্ষুরধার বক্তব্য রাখেন তিনি। এরপরেই সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে বামপন্থীদের হামলায় তিনি শাহদাতবরণ করেন। এটি ছিল ইসলামী জমিয়তে তলাবার ১ম শাহদাত। পশ্চিম ও পূর্ব মিলে এর আগে কোথাও শাহদাতের ঘটনা ঘটে নি।
১৯৭১ সালের গণ্ডগোলের সময় সভাপতি ছিলেন শহীদ আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যর্থতার জেরে গণহত্যার মুখোমুখি হয় এদেশের ইসলামপন্থী সমাজ। বহু আলেম-ওলামা, ইমাম-মুয়াজ্জিন, মাদ্রাসা শিক্ষক মুক্তি নামের ভারতপন্থীদের হাতে খুন হতে থাকে। এর ব্যতিক্রম হয় না জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রসংঘের ব্যাপারেও। হাজারো নেতা-কর্মী গণহত্যার মুখোমুখি হয়।
১৯৭২ সালে ছাত্রসংঘের যারা বেঁচে থাকতে সক্ষম হয়েছেন তারা বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন। একটা বড় অংশ দেশের বাইরে চলে যান। কেউ কেউ এলাকা থেকে পালিয়ে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেন। ইতিহাসের এই কঠিন সন্ধিক্ষণে প্রথমে ঢাকায় কয়েকজন মিলিত হয় এবং ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। পরে ঢাকার বাইরে খুলনায় একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ছোট্ট অথচ যুগান্তকারী এ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় খুলনার বয়রায় জনাব সিদ্দিক জামালের বাসায়। দুই রাত ও ১ দিনের এ মিটিং চলে।
যেখানে উপস্থিত ছিলেন:
১. আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ
২. আবু নাছের মোহাম্মদ আবদুজ জাহের
৩. মীর কাসেম আলী
৪. মরহুম মাওলানা সামছুল হক
৫. মাসুদ আলী
৬. সরদার আবদুস সালাম
এ মিটিংয়ের মাধ্যমে এক ঐতিহাসিক বিপদসংকুল, দুস্তর, দুঃসাধ্য পথের যাত্রা শুরু হয়। উক্ত বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে নিম্নোক্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় :
১. সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে একটি কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলার জন্য সকল শক্তি নিয়োজিত করা।
২. উক্ত উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষে বাংলাদেশের ইসলামপন্থী-ইসলামীমনা সাহসী যুবকদেরকে সচেতন করা, সক্রিয় করা।
৩. আমাদের এ লক্ষ্য উদ্দেশ্যের সাথে ঐক্যমত পোষণকারী ছাত্রের অন্বেষণ এবং আগ্রহ প্রদর্শনকারী ছাত্রদেরকে নৈতিক ও আত্মিক জ্ঞান ও কর্মে গড়ে তোলা।
৪. সময়, সুযোগ, পরিবেশ ও পরিস্থিতিকে সামনে রেখে সম্ভাব্য সাংগঠনিক কাঠামো দাঁড় করানো।
৫. আমাদের তামাম তৎপরতা হবে গঠনমূলক, নিয়মতান্ত্রিক আইনানুগ, কোন হটকারি আবেগ তাড়িত পথে পা বাড়ানো হবে না বলে দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
জাতিগঠনের এ তৎপরতাকে একটি সংবিধিবদ্ধ আঙ্গিকে নিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে জনাব অধ্যাপক এ. কে. এম. নাজির আহমদ সাহেবকে সভাপতি করে ৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির কাজ ছিল স্বল্প সময়ের মধ্যে একটি গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করা।
মীরপুরের পল্লবীতে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। উক্ত বৈঠকের প্রধান সিদ্ধান্ত ছিল সারাদেশব্যাপী একটি চিহ্নিত মহলের দ্বীন ও দেশ বিরোধী বিষাক্ত তৎপরতার মোকাবেলায় সাধারণ ছাত্রদেরকে ইসলামী জীবন বিধানের আলোকে গড়ে তোলার স্বার্থে একটি দাওয়াতী সংগঠন গড়ে তোলা। এর নাম দেওয়া হয় 'ছাত্র ইসলামী মিশন'। ইতিহাস সাক্ষী, অতি অল্প সময়ের মধ্যেই এই সংগঠন বিপুলভাবে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকে আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়। উক্ত সংগঠনের সভাপতি ছিলেন জনাব মাওলানা আবু তাহের।
১৯৭৫ সাল। এটি আর একটি ঐতিহাসিক বছর। এ বছর ঢাকায় যুবকদের জন্যে Youngman Muslim Association গঠন করা হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই এই Association ঢাকার যুবকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। একই বছর একটি পরিপূর্ণ প্রকাশ্য ইসলামী ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলার লক্ষ্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় এবং ধীরে ধীরে এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য একটি সুবিন্যস্ত প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়। সারা বছর ধরে এ প্রকল্পের কাজ চলতে থাকে। এভাবে '৭৫ সাল অতিবাহিত হয়। ইতিমধ্যে জমিন সিক্ত হতে থাকে। আমরা এর উর্বরতা লক্ষ্য করতে থাকি। বাংলাদেশের সর্বত্র একটি প্রকাশ্য ছাত্র আন্দোলন পাওয়ার আকাংখা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।
১৯৭৬ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে অনুষ্ঠিত বৈঠকে একটি নতুন ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলার পথে বাধা- বিপত্তি, জটিলতা, সমস্যা-সম্ভাবনা সবকিছু চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়। দীর্ঘ ও ফলপ্রসূ আলোচনা শেষে একই বছরের ১৬ই ডিসেম্বরের ইসলামপন্থী দায়িত্বশীল ছাত্রদের একটি কনভেনশন ডাকার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭৬ আমন্ত্রণপ্রাপ্ত ২২১ জন ছাত্র প্রতিনিধি বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে যোগদান করেন। সারাদেশে তৎপরতার রিপোর্ট পেশ এবং একটি প্রকাশ্য নতুন ছাত্র সংগঠন গঠনের লক্ষ্যে ১০০ ভাগ সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এখানে উল্লেখ্য যে, তখনকার দায়িত্বশীলগণ নতুনভাবে সংগঠনকে কীভাবে চালু করবেন তা নিয়ে অনেকগুলো পাইলট প্রকল্প চালিয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিল 'ছাত্র ইসলামী মিশন' ও 'ইয়ংম্যান মুসলিম এ্যাসোসিয়েশন'। পাইলটিং শেষে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন তারা আগের মতোই একটি সংগঠন নতুনভাবে নতুন আঙ্গিকে চালু করবেন।
কুমিল্লার ছোটরায় অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলন এদেশের ইসলামী আন্দোলনের জন্য একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। কেন্দ্রীয় নেতারা যেভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা সারাদেশের দায়িত্বশীলদের কাছে পৌঁছানো তাদের মতামত নেওয়ার জন্য একটি সম্মেলনের প্রয়োজন হয়। একটি বিয়ের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
বিয়ের অনুষ্ঠানে যারা মেহমান হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, তারা এসেছিলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, শহর ও মহকুমা থেকে। এরা সবাই ইসলামী ছাত্র সংঘের দায়িত্বশীল পর্যায়ের জনশক্তি ছিলেন। বিয়েটা ছিল তৎকালীন ছাত্রসংঘের সভাপতি আনম আব্দুজ জাহের সাহেবের। বিবাহোত্তর পরবর্তী দিনে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় বিয়ের অনুষ্ঠানের মোড়কে। যা পরিচালনা করেন জনাব মীর কাসেম আলী। এই সম্মেলনেই নতুন সংগঠনের যে চিন্তা ছিল তা অনুমোদিত হয়।
সর্বাধিকসংখ্যক প্রতিনিধির মতামত অনুযায়ী এ নতুন ছাত্র সংগঠনের নাম "ইসলামী ছাত্রশিবির" হিসাবে চূড়ান্ত হয়। একই সময়ে পরবর্তী নেতৃত্ব নির্ধারণের জন্য নির্বাচনের প্রক্রিয়া চলতে থাকে। অধ্যাপক নাজির আহমদ সাহেব নির্বাচন কমিশনার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর এই সংগঠনের সভাপতি হিসাবে জনাব মীর কাসেম আলীর নাম ঘোষণা করেন। জনাব মু. আবদুল বারী ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রথম সেক্রেটারি জেনারেল মনোনীত হন।
এদিকের কর্মকান্ড চূড়ান্ত হওয়ার পর পাবলিক ঘোষণার আগে দায়িত্বশীলরা মাওলানা মওদূদীর অনুমোদন নিতে চাইলেন। তিনি সকল কর্মকান্ডে সায় দিলেন এবং ইসলামী আন্দোলনের কাজ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী অকুতোভয় যুবকদের প্রশংসা করলেন।
১৯৭৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে বিলুপ্ত হয় ইসলামী ছাত্রসংঘ। নতুন সংগঠনে ইসলামী ছাত্রসংঘের জনশক্তিতে যোগ দিতে আহবান করা হয়। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৭৭ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের মিম্বারের পাশে বসেই আবু নাছের মোহাম্মদ আবদুজ জাহের বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন।
দুনিয়ায় আসলো বাংলার প্রভাব সৃষ্টিকারী আলোর কাফেলা বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। মুশরিকদের ঘেরাও-এর মধ্যে অবরুদ্ধ হয়েও সারা পৃথিবীতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার এক দুঃসাহসী স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে ছাত্রশিবির। শুরু থেকেই শিবির জানে তারা আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। লক্ষ ত্যাগের নমুনা পেশ করেছে শিবির, জীবন দিয়েছে এখন পর্যন্ত ২৩৪ জন।
❤️
উত্তরমুছুন