পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর মুসলিম লীগ ইংল্যান্ডের পরামর্শ অনুযায়ী দেশকে সেক্যুলার বানাতে চেয়েছিল। কিন্তু রুখে দাঁড়িয়েছে কথিত মওদূদীবাদের লোকেরা। অন্য সব ঘরানার আলেমদের সাথে নিয়ে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন শুরু করে। এর ফলাফল হিসেবে পাকিস্তান ইসলামিক রিপাবলিকে পরিণত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানে সুদ বন্ধ হয়। শরিয়াহ কোর্ট চালু হয়।
ইংরেজ আমলে তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় কাদিয়ানীরা নানান সরকারি চাকুরি অংশ নেয়। পাকিস্তান গঠনের পর কাদিয়ানীদের উচ্চপদস্থ আমলা ও সেনাবাহিনী অফিসাররা পাকিস্তানের হর্তা কর্তা হয়ে কাদিয়ানী মতবাদের প্রচার প্রসার করতে থাকে। খতমে নবুয়তের মতো বেসিক বিষয়ে দ্বিমত করে মুসলিম থাকা যায় না। মুসলিমদের রাষ্ট্রে কাদিয়ানীদের এই প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করেন মওদূদী। কথিত মওদূদীবাদের অনুসারীরা পাকিস্তানকে কাদিয়ানীদের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিল। সেই চেষ্টায় মওদূদী ফাঁসীর দড়ির কাছাকাছি চলে গিয়েছিল।
১৯৫৭ সাল। আওয়ামীলীগ তখন পাকিস্তানের ক্ষমতায়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। পাকিস্তানে সংবিধান পাশ হয়। পাকিস্তানকে ইসলামিক রিপাবলিক ঘোষণা দেয়। আওয়ামীলীগ থেকেই এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়। কমিউনিস্ট ভাসানী কাগমারিতে সম্মেলন আহবান করে। নিজ দলের নেতা সোহরাওয়ার্দিকে তিনি দুইটি কারণে সালাম জানিয়ে বিদায় দেওয়ার কথা বলেন। ১. পাক-মার্কিন সিয়োটা চুক্তি। ২. পাকিস্তানকে ইসলামিক রিপাবলিক ঘোষণা।
ভাসানী গণ্ডগোল লাগিয়ে দিলো। সারা পাকিস্তানে বামভাবাপন্ন রাজনীতিবিদেরা পরিস্থিতি ঘোলাটে তৈরি করলো। গভর্ণর জেনারেল ইসকান্দর মীর্জাও সোহরাওয়ার্দির বিপক্ষে গেল। এক পর্যায়ে ভাসানী বেশ কয়েকজন এমপিকে নিয়ে আওয়ামীলীগ ভেঙ্গে দিল। তাতে সোহরাওয়ার্দি সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে ফেলে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলো। ঘোর রাজনৈতিক সংকট তৈরি হলো। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন হলো সেনাপ্রধান আইয়ুব খান। সে সামরিক শাসন শুরু করলো ও গণতান্ত্রিক পাকিস্তানের বিদায় ঘটলো। ভাসানীসহ বামপন্থীরা আইয়ুবকে সাপোর্ট করলো।
পরবর্তীতে মানুষের নেতা নির্বাচন অধিকার ফিরিয়ে আনার মাওলানা মওদূদী আবার রাস্তায় নামলেন। সকল দলকে একত্র করে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কন্ঠ উচ্চকিত করলেন। ১৯৬১ সালে আইয়ুব জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে। তারপরও থেমে যায় নি কথিত মওদূদীবাদীরা। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয় কাশ্মীর ইস্যুতে। সেসময় আইয়ুব দেশ রক্ষায় মওদূদীর দ্বারস্ত হয়। মওদূদী আইয়ুবের অনুরোধে সংকটকালে দেশ রক্ষায় পাকিস্তানের রেডিওতে সকল জনগণ ও রাজনীতিবিদদের এক হতে বলেন। কথিত মওদূদীবাদীরা উম্মাহ চেতনায় মুসলিমদের জাগ্রত দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে। কিন্তু যুদ্ধ শেষে আইয়ুব আবারো তার হীন ও নীচ খেলা খেলতে থাকে।
দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে, বিশেষ করে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী জমিয়তে তলাবার ছাত্রদের অপরিসীমের ত্যাগের মধ্য দিয়ে আইয়ুবের পতন হয়। ১৯৭১ সালে ভারতীয় মুশরিকদের সহায়তায় পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থাকা কিছু বাঙালি গাদ্দার। আর এর রাজনৈতিক নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগ।
১৯৭১ সালে শেখ মুজিব দেশ স্বাধীন করে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এদেশের ইসলামপন্থীদের ওপর ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে আসে। এটা অনুমিত ছিল। কারণ মুসলিম জাতীয়তাবাদের ইস্যুতে সৃষ্টি হওয়া পাকিস্তানকে ভাঙতে দিতে চায়নি সকল ধর্মপ্রাণ মুসলিম। ১৮ ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধ শুরু করে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনাবাহিনী। বিশেষত কাদের সিদ্দিকীর অধীনে কাদেরিয়া বাহিনী ও জেনারেল ওবানের অধীনে মুজিব বাহিনী। ঢাকা ও তার আশপাশের মুসলিম লীগের নেতা কর্মী, নেজামে ইসলামের নেতা কর্মী, জামায়াতে ইসলামের নেতা-কর্মী, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মী, ন্যাপের নেতা-কর্মী, মসজিদ্গুলোর ইমাম মুয়াজ্জিন, কওমী মাদ্রাসার শিক্ষক ও সিনিয়র ছাত্রদের পল্টন ময়দানে জমায়েত করা হতো। তারপর তাদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হতো। এটা কোনো গোপন ঘটনা ছিল না। এটি ছিল খুবই প্রকাশ্য এবং দেশি-বিদেশী সাংবাদিকদের সামনে চলে বেসামরিক নাগরিক হত্যা। এদের অপরাধ ছিল তারা পাকিস্তান ভেঙে যাক এটা চায়নি।
একইসাথে ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের সব ক্যান্টনমেন্ট দখলে নিয়ে সেখানের অস্ত্র, গোলাবারুদ ও অন্যান্য সম্পদ লুটপাট করে। এটাও ছিল যুদ্ধাপরাধ। বিরোধী মতের রাজনৈতিক নেতাদের বাড়ি ঘর দখল ও লুটপাটের আয়োজন করে মুক্তিবাহিনী। এ সবই ছিল যুদ্ধাপরাধ। যে মুহাজিররা ১৯৪৭ সালে ভারতের বিহার থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলায় এসেছিল তাদের মধ্যে অনেকে মুক্তিবাহিনীর অত্যাচারে আবার ভারতে পাড়ি জমান। এ এক জিল্লতির জীবন ছিল। বিহারীরা ফিরে যেতে পারলেও এদেশের ইসলামপন্থীদের পালানোর জায়গা ছিল না বললেই চলে। সেসময়ের বেশ কয়েকজন ভিকটিমের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি তারা নির্যাতনের মুখে তাদের নিজ জেলা থেকে পালিয়ে দূরের জেলায় পালিয়ে থেকেছে।
শুধু যে ইসলামপন্থীরা আক্রান্ত হয়েছে তা নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা ইসলাম বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তারা ইসলামের প্রতি আক্রোশ দেখিয়েছে। যে সকল প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার নামে ইসলাম ও মুসলিম ছিল সেগুলো থেকে তারা ইসলাম ও মুসলিম শব্দ বাদ দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মুসলিম বাদ দেওয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো থেকে 'রাব্বি জিদনি ইলমা' ও কুরআনের চিহ্ন বাদ দেওয়া হয়েছে। নজরুল ইসলাম কলেজ থেকে ইসলাম বাদ দিয়েছে। পাবনার সেরা কলেজ ইসলামিয়া কলেজকে বুলবুল কলেজে পরিণত করা হয়েছে। এভাবে সারা বাংলাদেশে সব স্থান ইসলাম ও মুসলিমকে উৎখাত করা হয়েছে। কওমী মাদ্রাসাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রী ও শিক্ষিকাদের বোরকা নিষিদ্ধ করে শাড়ি পড়তে বাধ্য করা হয়েছে। এই কারনে বহু ছাত্রী একাত্তর পরবর্তীতে বিদ্যালয়ে শিক্ষা নিতে যায় নি।
সংবিধান প্রণয়ন করে বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই যে, নেজামী ইসলামী ও জামায়াতে ইসলামী এই দুইদলই ছিল সেসময় ইসলামী রাজনীতির ধারক ও বাহক। এদের নিষিদ্ধ করা হয় নাই যে, তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিলেন। বরং তাদের এইজন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে যে, তারা ইসলামী রাজনীতি করেন। সেসময় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী ন্যাপ (মুজাফফর), মনি সিং এর কমিউনিস্ট পার্টি, জাতীয় দল, কৃষক শ্রমিক পার্টি, পূর্ব-পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি, পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি এবং কৃষক শ্রমিক সমাজবাদী দল এই দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। সুতরাং এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধের যারা কুশীলব তাদের মূল আক্রোশ ছিল ইসলামের সাথে। এই সাধারণ ব্যাপার সেসময়ের সকল ইসলামী রাজনীতিবিদ বুঝেছিলেন এবং তারা এজন্যই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিলেন। সেসময়ের অনেক মুসলিম না বুঝে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলো এটা তাদের ব্যর্থতা ও অদূরদর্শিতা ছিল। আল্লাহ তায়ালা তাদের ক্ষমা করুন।
সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও বিরাট পরিবর্তন এনেছে মুক্তিযোদ্ধারা। তারা রেডিও টেলিভিশনে বিসমিল্লাহ, সালাম দিয়ে শুরু করা বাদ দিয়ে সুপ্রভাত, শুভকামনা ইত্যাদি প্রতিস্থাপন করেছে। রেডিওতে কুরআন তিলওয়াত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ইসলামী একাডেমি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই ইসলামী একাডেমীকেই তিনবছর পরে ইসলামী ফাউন্ডেশন নামে চালু করা হয়েছে। ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আবার পুনরায় রেডিও টেলিভিশনে সালাম, বিসমিল্লাহ, আযান ও কুরআন তেলওয়াত শুরু হয়েছিল।
মুজিব পরিবেষ্টিত ছিলেন তাজউদ্দিনদের মতো এক ঝাঁক কমিউনিস্ট দ্বারা। তার ফলে মুজিবের শাসনামলের শুরুর দিকে সমস্ত ইসলামবিরোধী কাজের জোয়ার শুরু হয়েছিল। সংবিধান থেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র বাদ পড়েছে। মূলনীতি থেকে আল্লাহর ওপর বিশ্বাস বাদ দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে কমিউনিজম, সেক্যুলারিজমের মতো ইসলাম ও ধর্ম বিদ্বেষী মতবাদকে। ক্ষমতায় থেকে ইসলামপন্থা দমনে সব কাজ করেছেন শেখ মুজিব। যখন জাসদ গঠিত হয় এবং বামপন্থীদের সাথে সরকারের চরম বিরোধ শুরু হয় তখন মুজিব কোনঠাসা হয়ে থাকা ইসলামপন্থীদের কাছে টানতে থাকেন তার শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য। তবে অবশ্যই তিনি ইসলামী রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেননি। তিনি শুধুমাত্র অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অনুমতি দিয়েছেন। তাবলীগের প্রসার করার চেষ্টা করেছেন। কওমীদের শুধুমাত্র মাদ্রাসার গণ্ডির মধ্যে থেকে পড়ালেখার কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন।
এই কঠিন অবস্থায় মওদূদীবাদের অনুসারীরা থেমে থাকে নি। কথিত মওদূদীবাদ ছাড়া বাকীরা সবাই ইসলামী রাজনীতি আর চালু হবে না এই মর্মে ঐক্যমত পোষণ করে ইসলামী রাজনীতি থেকে দূরে চলে গেছেন। কিন্তু মওদূদীবাদ মুসলিম থামতে দেয়নি। মওদূদীবাদ ছিল এদেশের ইসলামের ঢাল। কথিত মওদূদীবাদই ইসলামকে বাংলাদেশে পুনরায় জাগিয়ে তুলেছে।
১৯৭১ সালে মুজিবের কর্মকান্ডের পর আরবরা আমাদের ত্যাগ করেছিল। জামায়াতের কর্মীরা মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের জন্য জায়গা করে নিয়েছে। পুরো মুসলিম বিশ্বের সাথে বাংলাদেশ যোগাযোগ স্থাপন করিয়ে দিয়েছে। মুজিবের মৃত্যুর পর ইসলামকে দ্রুতই রাজনীতির মূল ট্র্যাকে নিয়ে এসেছে। সারা দেশে প্রতিটি জেলায় স্কুল কলেজ ও ও মাদ্রাসা স্থাপন করে বাংলার সন্তানদের মন ও মগজে ইসলামকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে। বাংলার মুসলিমদের মধ্যে ইসলামী সংস্কৃতি পুনরায় স্থাপন করার কাজ হাতে নিয়েছিল।
চলবে ...
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন