২৭ মার্চ, ২০২৪

মওদূদীবাদের স্বরূপ উদ্ঘাটন || পর্ব ০৫

১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলায় মুসলিম শাসনের অবসান হয় ও ইংরেজদের বর্বর শাসন শুরু হয়। ক্ষমতা দখল করেই ইংরেজরা দীর্ঘ ৫৫০ বছরে গড়ে ওঠা শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়। বাংলার দুইটি বিষয়ের ব্যাপারে তারা খুবই কনসার্ন ছিল। এক বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা, দুই বাংলার শিল্প।

তারা ক্ষমতা দখল করেই এই দুটি সেগমেন্ট তারা বন্ধ করে দেয়। সকল শিল্প কারখানা বন্ধ করে দেয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল টেক্সটাইল, জাহাজ শিল্প ও যুদ্ধাস্ত্র। শুধু শিল্প কারখানা বন্ধ নয়, শিল্প কারখানা যাতে আর কোনোদিন গড়ে না ওঠে এজন্য সকল উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। বস্ত্র শিল্প ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য হুমকি। এদেশের ভালো কাপড়ের বিপরীতে ব্রিটিশদের নিন্মমানের কাপড় চালানোর জন্য তারা বস্ত্রশিল্পকে একেবারে নির্মূল করে দিয়েছে।

যারা তাঁতের ইঞ্জিনিয়ার/ কারিগর ছিল তাদের প্রতি হুমকি ছিল তারা যাতে মেশিন তৈরি না করে। আর যারা লুকিয়ে মেশিন তৈরি ও এর আপগ্রেডেশনের সাথে যুক্ত ছিল তাদের হাত কেটে দেওয়া হয়েছিল। মাত্র দশ বছরের ব্যবধানে বাংলার সকল শিল্প বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। এর মাধ্যমে ব্রিটিশদের পণ্য এদেশে চালু হতে শুরু করে। বাংলার ইতিহাস থেকে শিল্প কারখানা ও শিল্প গবেষণা হারিয়ে গেছে। আর অন্যদিকে ইউরোপে শিল্প গবেষণা এগিয়ে যায়। আমাদের এখানে লুটপাট ও মনোপলি বিজনেস করে ইউরোপে শিল্প বিপ্লব সাধিত হয়।

এদেশের মানুষ যাতে পিছিয়ে থাকে ও সভ্যতার বিকাশ না ঘটে সেজন্যে ব্রিটিশরা এখানের সকল উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। কোনো জাতির মধ্যে শিক্ষা না থাকলে প্রথমত তারা সভ্যতার বিকাশে অংশ নিতে না পারায় হারিয়ে যায়। দ্বিতীয়ত নিজেদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা ভুলে অন্য জাতির গোলামীর পথ ধরে। বাংলায় এই ব্যাপারটাই হয়েছে।

যতদূর জানা যায় এই বাংলায় সভ্যতার বিকাশ হয়েছে দ্রাবিঢ় জাতিগোষ্ঠীর মাধ্যমে। তারা ছিল নূহ আ.-এর সরাসরি বংশধর ও একেশ্বরবাদী। সেসময় গোত্রভিত্তিক মানুষ বসবাস করতো। প্রতিটা গোত্রে কয়েকজন পণ্ডিত মানুষ থাকতেন। তাদের বাড়িই ছিল জ্ঞানর্জনের কেন্দ্র। প্রাথমিক লেখাপড়া সবাই করতো। এর মধ্যে যারা সক্ষম ছিল তারাই জ্ঞানের ধারাকে এগিয়ে নিতেন। জ্ঞানের শাখা-প্রশাখা সীমিত ছিল বিধায় একজন জ্ঞানী ব্যাক্তি সকল বিষয়ে জ্ঞানী ছিলেন। যেমন কৃষি, শিল্প, ধাতুবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান সব বিষয়েই তারা পারদর্শী ছিলেন।

এরপর ইরান থেকে বহুঈশ্বরবাদী আর্যরা এসেছে এখানে ও উপমহাদেশের উত্তর দিক থেকে ধীরে ধীরে দখলে নেয়। বাংলার দ্রাবিঢ়রা দীর্ঘদিন তাদের ঠেকিয়ে রাখলেও এক পর্যায়ে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দ্বারা পরাজিত হয়। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অত্যাচারের শিকার হয় এখানকার জ্ঞানী সমাজ ও পন্ডিত ব্যাক্তিরা। ব্রাহ্মণ্যবাদী সভ্যতায় জ্ঞানর্জন শুধুমাত্র ব্রাহ্মণদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। আর কিছু প্রাথমিক জ্ঞান ক্ষত্রিয়, বৈশ্যরা পেত। শুদ্র ও এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দাদের জন্য জ্ঞানর্জন নিষিদ্ধ ছিল।

একেশ্বরবাদী বুদ্ধের আগমনের পর এদেশের বেশিরভাগ মানুষ বৌদ্ধধর্মের অনুসারী হন। বৌদ্ধ ধর্মের হাত ধরে এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি সাধিত হয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার ধারা শুরু হয় বিহার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। গুপ্ত আমলে আর্যরা বৌদ্ধ ধর্মের ওপর ব্যাপক অত্যাচার করে। বিহারগুলো ধ্বংস করে। আবারো ক্ষতিগ্রস্থ হয় এই অঞ্চলের শিক্ষা।

বৌদ্ধরা আবারো ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ওপর বিজয়ী হয়। পাল আমলে আবারো বাংলায় প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা চালু হয়। পাল আমলে মুসলিমরা সারা বিশ্বে মাদরাসা বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে। সে সময়ে সভ্যতায় সবচেয়ে এগিয়ে ছিল বাগদাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। বাংলায়ও মুসলিমরা আসতে শুরু করেছে ও এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দাদের প্রায় সবাই মুসলিম হয়ে গেছে। বহুঈশ্বরবাদীদের মধ্যে যারা নিন্ম বর্ণের ছিল তারা ও বৌদ্ধরা দ্রুতগতিতে ইসলামে দাখিল হতে থাকে। মুসলিমরা পাড়াভিত্তিক মক্তব ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে। এই নিয়ে হিন্দু/ আর্য জমিদারদের সাথে প্রায়ই বিবাদে লিপ্ত হতে হতো। বিহার বা বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি জাগতিক শিক্ষাও হতো। ফলে দেখা যায় উচ্চশিক্ষার জন্য সকল ধর্মের (হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিম) লোকেরা বৌদ্ধবিহারে যেতেন।

এরপর আসে সেন আমল অর্থাৎ আর্য হিন্দুদের আমল। এবার তারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষার প্রতিষ্ঠান পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করে। উচ্চশিক্ষার জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। তবে সেগুলো ছিল উচ্চ বর্ণের মানুষদের জন্য। বিহারগুলোর সাথে অসহযোগিতা ও ক্ষেত্র বিশেষে বন্ধ করে দিত। বেশিরভাগ সমস্যা হতো মুসলিমদের মাদরাসার সাথে। বাংলার বৌদ্ধরা ও মুসলিমরা বর্বর সেনদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে দিল্লির সুলতান, সিন্ধের মুসলিম শাসকদের কাছে প্রায়ই আবেদন করতেন।

কিন্তু বাংলায় রাস্তাঘাটের অপ্রতুলতা ও স্থল যোগাযোগের সুবিধা বেশি না থাকায় মুসলিমরা শাসকরা বাংলা কন্ট্রোলে আনতে পারেননি। এমন পরিস্থিতিতে ১২০৫ সালে আমাদের ত্রাণকর্তা হিসেবে আসেন আফগানিস্তানের ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি। তাঁর হাত ধরে বাংলায় মুসলিম শাসন শুরু হয়। প্রায় সাড়ে পাঁচশত বছর ধরে চলে মুসলিম শাসন। বাংলার শাসন ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, সভ্যতার উৎকর্ষ, বস্ত্র ও জাহাজ শিল্পের উন্মেষ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সবই হয় ৫৫০ বছরে। অনেক পর্যটক এই বাংলাকে পৃথিবীর জান্নাতের সাথে তুলনা করেছেন। এখানের প্রাচুর্য ও এখানের মাটিতে সারাবছর কৃষি কাজ করা যায় বিধায় এখানের মানুষ অভাবে পড়তেন না। যারা এখানে ব্যবসা ও ধর্মপ্রচারে এসেছেন তাদের সিংহভাগ এত সুন্দর পরিবেশ দেখে এখানে স্থায়ীভাবে থেকে গেছেন। আমার পূর্বপুরুষরাও এভাবে এই অঞ্চলের বাসিন্দা হয়ে যান।

বাংলায় সুলতানী আমলে শিল্পের বিপ্লবের মূলে ছিল এখানের বড় বড় মাদরাসাগুলো। বাংলার মুসলিম শাসনের শুরু থেকেই পাড়া ও মহল্লাভিত্তিক মাদরাসা, মসজিদভিত্তিক মক্তব চালু হয়ে যায়। মুসলিম সন্তানদের পাশাপাশি সকল ধর্মের মানুষ এসব প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা নিতেন। তখন সেক্যুলার শিক্ষা ছিল না। মাদরাসাগুলোতেই ইতিহাস, রাজনীতি, ধাতুবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, কবিতা, ভাষাবিজ্ঞান, আইনশাস্ত্র, রসায়ন, ভৌতবিজ্ঞান সবই পড়ানো হতো। পাশাপাশি ফিকহ, হাদীস, তাফসীরও পড়ানো হতো।

বাংলায় ১ম বিশ্ববিদ্যালয় মানের মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন শেখ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা। তিনি ছিলেন হাদিস বিশেষজ্ঞ ও ইসলামি আইনবিদ। রসায়ন, ভৌতবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানেও তিনি ছিলেন পারদর্শী। স্বাধীন সুলতানি আমলে বাংলায় আসেন তিনি। সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবনের শাসনকালে (১২৬৬-৮৭) তিনি দিল্লিতে পৌঁছেন এবং সেখান থেকে বাংলায় আসেন। এরপর সোনারগাঁতে তিনি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এরকম আরেকটি বড় প্রতিষ্ঠান হলো তৎকালীন গৌড় ও বর্তমান চাঁপাইনবাবগঞ্জের দারাসবাড়ি মাদরাসা।

সাড়ে পাঁচশত বছরে বাংলায় হাজার হাজার মাধ্যমিক মাদরাসা ও শ'খানেক জামেয়া/ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পরাজয়ের ক্ষত আমাদের এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। ইংরেজরা সমস্ত মাধ্যমিক মাদরাসা ও জামেয়া বন্ধের ঘোষণা দেয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বরাদ্দকৃত নিষ্কর লাখেরাজ সম্পত্তি সরকারের অধিকারে নিয়ে নেয়। এতে মাদরাসাগুলোর আয় বন্ধ হয়ে যায়। মাদরাসায় জমি সরকার দখল করে প্রতিষ্ঠান গুঁড়িয়ে দেয়। এরপরও কিছু প্রসিদ্ধ শিক্ষক ব্যক্তিগতভাবে নিজ বাড়িতে শিক্ষা চালু রাখার চেষ্টা করেন। সেসব শিক্ষকদের নির্মমভাবে খুন করে ইংরেজরা।

১০ বছরের মধ্যে তারা বাংলাসহ উপমহাদেশের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে এক মূর্খ সমাজে পরিণত করার চেষ্টা চালায়। তাদের টার্গেট ছিল উপমহাদেশের মানুষ কেবল কৃষিকাজ করবে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পে তাদের কোনো ভূমিকা থাকবে না।

১৮০০ সাল থেকে তারা পাশ্চাত্য শিক্ষানীতির নামে নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করে। নতুনভাবে স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা ও পাঠ্য কার্যক্রমের পরিকল্পনা করে। এতে তাদের টার্গেট ছিল ভারতীয়রা যাতে ইংরেজদের প্রতি অনুগত থাকে সেরকম শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা। এজন্য তারা মুসলিম শাসনামলকে অন্ধকারচ্ছন্ন মধ্যযুগ বলে অভিহিত করে। তাদের পুরাতন সভ্যতাগুলো মহান ও মানবিক সভ্যতা হিসেবে উপস্থাপন করে। ইংরেজরা এদেশ থেকে মুসলিম শাসকদের হটিয়ে আমাদের অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে এসেছে এমন কথা দ্বারা পাঠ্যক্রম সাজায়। যাতে ভারতীয়রা ইংরেজদের মহান ভাবে। ইংরেজদের অনুসরণ করে তাদের অনুগত থাকাকে গর্বের বিষয় হিসাবে ভেবে নেয়।

১৮৩৫ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি মেকলে তাঁর বিখ্যাত পাশ্চাত্য শিক্ষানীতির প্রস্তাব বড়লাটের কাছে পেশ করেন। এই প্রস্তাবের প্রধান দিকগুলি হল –

(১) তিনি প্রাচ্যের সভ্যতাকে ‘দুর্নীতি, অপবিত্র ও নির্বুদ্ধিতা’ বলে অভিহিত করে সরাসরি পাশ্চাত্য শিক্ষার পক্ষে মত প্রকাশ করেন।
(২) তাঁর মতে প্রাচ্যের শিক্ষায় কোনও 'বৈজ্ঞানিক চেতনা' নেই এবং তা পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা অপেক্ষা সম্পূর্ণভাবে নিকৃষ্ট (Oriental learning was completely inferior to European learning”)।
(৩) তাঁর মতে, “ভালো ইউরোপীয় গ্রন্থাগারের একটি তাক আরব ও ভারতের সমগ্র সাহিত্যের সমকক্ষ। বলা বাহুল্য, মেকলের এই মত ছিল সম্পূর্ণভাবে অহমিকা-প্রসূত ও অজ্ঞানতাপূর্ণ।
(৪) তিনি বলেন যে, উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষা বিস্তৃত হলে তা ‘ক্রমনিম্ন পরিস্রুত নীতি’ (Downward Filtration Theory) অনুযায়ী ধীরে ধীরে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে।
(৫) মেকলের লক্ষ্য ছিল সাংস্কৃতিক বিজয়। তিনি বলেন যে, পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলে এমন এক ভারতীয় গোষ্ঠী তৈরি হবে যারা “রক্তে ও বর্ণে হবে ভারতীয়, কিন্তু রুচি, মত, নৈতিকতা এবং বুদ্ধিমত্তায় হবে ইংরেজ।”

মেকলের এই প্রস্তাবনা অনুসারেই পাশ্চাত্য শিক্ষাক্রম চালু করে করে ইংরেজরা। একই সাথে ইংরেজরা পাঠ্যক্রমে 'বৈজ্ঞানিক চেতনা'র নামে সেক্যুলার শিক্ষা চালু করে। যাতে মানুষ জীবন যাত্রায় ধর্মের কোনো সংযুক্ততা না পায়। ধর্মকে শুধুমাত্র আচার ও রীতিনীতি সর্বস্ব সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। মুসলিম ও হিন্দুরা যাতে ভেবে নেয় ধর্মই তাদের পিছিয়ে যাওয়া ও পরাজিত হওয়ার মূল কারণ। যত দ্রুত ধর্মকে ছেড়ে দেবে ততই উন্নতি হবে এমন শিক্ষা দেওয়া হয় ভারতীয়দের। ইংরেজদের এই পাশ্চাত্য শিক্ষানীতি ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে উপমহাদেশে। নির্যাতন, দুর্নীতি ও শোষণ করে দুর্ভিক্ষে ঠেলে দিলেও ইংরেজদের সভ্য ও মহান ভাবতে থাকে এই অঞ্চলের মানুষরা।

নানা ঘটনা ও উপ-ঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালে আমরা ইংরেজদের থেকে স্বাধীনতা লাভ করি। কিন্তু আমাদের নীতি নির্ধারকেরা পূর্বের মিথ্যা ও ফাঁকা বুলি সর্বস্ব শিক্ষানীতিকে পরিত্যাগ করতে সক্ষম হয় নি। পাকিস্তান আমলে পূর্বের পাশ্চাত্য শিক্ষার সাথে কিছু ধর্মীয় শিক্ষা যুক্ত হয়েছে ও ইতিহাসে মুসলিম শাসনকে পুনরায় আলোকজ্জল হিসেবে দেখানো ছাড়া তেমন কোনো পরিবর্তন হয় নি। তাতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব কাটানো যায় নি। ইংরেজি সভ্যতা, তাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও তাদের আইন দিয়ে বিচার ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হয়। এটিও হয়েছে পাশ্চত্য শিক্ষানীতির জন্য।

১৯৭১ সালে আমরা পুনরায় স্বাধীন হই। সেই থেকে এখন পর্যন্ত ৭ টি শিক্ষা কমিশন গঠন হয়েছে। প্রথমটি ছিল শেখ মুজিবের সময়কালে কুদরত ই খুদা শিক্ষা কমিশন। এই কমিশন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় মারাত্মক গলদ ঢুকিয়ে দেয়। পাশ্চাত্য শিক্ষার পাশাপাশি হিন্দুত্ববাদ প্রবেশ করানো হয়। এরপরে যতগুলো শিক্ষা কমিশন হয়েছে তার কোনোটাই পাশ্চাত্য ও সেক্যুলার শিক্ষানীতি থেকে বের হতে পারেনি। জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার শাসনামলে এই হিন্দুত্ববাদ কিছুটা দূর হলেও ২০০৯ সালে কবির চৌধুরীর শিক্ষানীতি পুনরায় হিন্দুত্ববাদ ঢুকিয়ে মুসলিম পরিচয়কে মুছে দিতে চাইছে।

এদেশের মুসলিমরা ইংরেজদের থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেও এখন পর্যন্ত ১৭৫৭ সালের পরাজয়ের গ্লানি টেনে বেড়াচ্ছে। দেশের সীমারেখা পরিবর্তন হয়েছে, উপনিবেশিক ও অত্যাচারী এদেশ ছেড়ে চলে গেছে কিন্তু আমাদের বাংলাদেশী ও মুসলিম হিসেবে স্বতন্ত্র শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে সক্ষম হইনি। ইংরেজদের পাশ্চাত্য শিক্ষানীতির সাথে হিন্দুত্ববাদ যুক্ত করে এক আত্মঘাতী জগাখিচুড়ী শিক্ষা কার্যক্রম চলছে বাংলাদেশে।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান আমল থেকেই সেক্যুলার শিক্ষা বাদ দিয়ে বাংলার স্বর্ণযুগ মুসলিম শাসনামলের মতো জাগতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার সমন্বয়ে সমন্বিত শিক্ষার জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছে। ১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের চেষ্টা চালান। শিক্ষা কীরূপ হবে এই নিয়ে ঢাবিতে একটি বিতর্কসভার আয়োজন করা হয়। জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা আব্দুল মালেক ইসলামের আলোকে শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর জন্য বলিষ্ঠভাবে বক্তব্য রাখেন। তাঁর যুক্তিপূর্ণ বক্তব্যে সেক্যুলার শিক্ষার পক্ষে থাকা লোকদের বক্তব্যগুলো অসার ও অবৈজ্ঞানিক প্রমাণিত হয়। এই বক্তব্য দেয়ার অপরাধে ঢাবির প্রাণরসায়ন বিভাগের ছাত্র আব্দুল মালেককে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে ঢাবি ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন।

আমরা এখনো সেই অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিক সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থায় থাকায় আমাদের জাতি গঠনে আমরা পিছিয়ে পড়েছি। আমাদের সন্তানেরা ইউরোপে যাওয়াটাকেই সফলতা জ্ঞান করে। একটা গোলামী মানসিকতা তৈরি হয়েছে। পড়ালেখার উদ্দেশ্য হয়েছে চাকুরি করা ও যেকোনো ভাবে টাকা উপার্জন। গবেষণা উঠেই গেছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে। নিজস্ব সংস্কৃতিকে পশ্চাতপদ মনে করে বিজাতীয় সংস্কৃতিতে গা ভাসিয়ে দিয়েছি। আত্মমর্যাদা ও আত্মবিশ্বাস হারিয়ে এক উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছি। শিক্ষিতদের অধিকাংশই দুর্নীতির সাথে যুক্ত হয়েছে। সেক্যুলার শিক্ষা আমাদের ভালো মানুষ হতে শেখায় না। যা আমাদের জাতীয় মেরুদণ্ডকে ধ্বসিয়ে দিয়েছে।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে টু দ্য পয়েন্ট প্রস্তাবনা সব শিক্ষা কমিশনকেই দিয়েছে। এই নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও একটি প্যারালাল একটি শিক্ষা বোর্ড চালু করেছে জামায়াত। শুধু তাই নয়, জামায়াতের শিক্ষা বোর্ড প্রস্তাবিত পাঠ্যক্রমের আলোকে পাঠ্যপুস্তক তৈরি করেছে। এসব সিলেবাস ও পাঠ্যপুস্তককে ইমপ্লিমেন্ট করার জন্য জেলাভিত্তিক স্কুল ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছে। এছাড়া ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবির বিকল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্কুল ও মাদরাসার ছাত্রদের মধ্যে জ্ঞানের সমন্বয় করছে। আলোকিত মানুষ তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়ায় উদ্যোগটি বার বার ব্যহত হচ্ছে। এর মধ্যে আরো দুঃখজনক ব্যাপার হলো গত এক দশকে এই সকল স্কুলের প্রায় সবই সরকার দখল করে নেয়।

যাই হোক এদেশে জামায়াত বা কথিত মওদুদীবাদ হলো ইসলামের ঢাল। এই ঢাল যেদিন হারিয়ে যাবে বা পথ হারাবে সেদিন ঈমান নিয়ে এদেশে বসবাস করা কঠিন হয়ে যাবে। এবং তা হচ্ছে।

আপনারা দেখেছেন কিছুদিন আগে ঢাবিতে ৭২ টি পূজা মন্ডপে স্বরসতী পূজা হয়েছে। জবিতে ৩৬ টি। এভাবে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বরসতী পূজা হয়েছে। অথচ সকল উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইফতার মাহফিল নিষিদ্ধ হয়েছে।

শেখ হাসিনার ক্ষমতা দখল হয়েছে ক্রমান্বয়ে। যুদ্ধ করে নয়। আর শেখ মুজিব ক্ষমতা দখল করেছে যুদ্ধ করে। মূর্তি পূজারীরা যুদ্ধ করে শেখ মুজিবকে ক্ষমতায় এনেছে। তাই শেখ মুজিবের একশন ছিল দ্রুত। শেখ মুজিব ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই হাজার হাজার ইসলামপন্থী রাজনীতিবিদ, আলেম ওলামা, ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মাদরাসা শিক্ষকদের হত্যা করেছে। ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। যে সকল প্রতিষ্ঠানের নামের মধ্যে ইসলাম ও মুসলিম লেখা ছিল সব প্রতিষ্ঠান থেকে ইসলামকে উতখাত করেছে। কওমি মাদরাসাগুলো বন্ধ করে দিয়েছে।

পরবর্তীতে বাধ্য হয়ে চালু করলেও শেখ মুজিব আলিয়া ও কওমি উভয় মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ডিগ্রীর স্বীকৃতি বাতিল করে দিয়েছে। রেডিও টেলিভিশনে সালাম, হামদ, নাতসহ সকল ইসলামী কালচারকে উতখাত করেছে। ইসলামের বিরুদ্ধে এমন কোনো ষড়যন্ত্র বাকী ছিল না যা শেখ মুজিব করেনি। মুসলিমের দেশ মূর্তি দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছিল। মূর্তি পূজারীদের নেতা ইন্দিরা গান্ধীর অনুসারী শেখ মুজিব আমাদের ঈমান নষ্ট করার কাজ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে জাহান্নামে লাকড়ি বানিয়ে দিন। আমিন।

এই দেশকে সেই অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য জামায়াত জীবন বাজি রেখে কাজ করেছিল। ইসলামী রাজনীতির অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মুসলিম দেশে মুসলিমদের কালচার প্রতিষ্ঠার সব চেষ্টা করেছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় অবদান রেখেছে। আলাদা পাঠ্যবই, শিক্ষা বোর্ড করে শতাধিক স্কুল, শতাধিক মাদরাসা স্থাপন করেছে। ইসলামী ব্যাংকিং চালু করেছে। ইসলামী সংস্কৃতি উন্মেষ ঘটিয়েছে। বাংলায় ইসলামী সাহিত্যের বিশাল ভান্ডার জনতার সামনে খুলে দিয়েছে। যাকাত ম্যানেজমেন্ট শিখিয়েছে। লাখো মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

জামায়াতের রাজনীতিতে ব্যাক করাটা ভালোভাবে নেয়নি মূর্তি পূজারীরা। তার সাথে যুক্ত হয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব। ২০০১ সালে পশ্চিমাদের মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ 'ওয়ার অন টেরর'-এ যুক্ত হয়নি বাংলাদেশ। এর খেসারত দিতে হয়েছে জামায়াত ও বিএনপি। মূর্তি পূজারীরা ও পশ্চিমারা এদেশের আওয়ামী লীগকে নিয়ে আমাদের দেশ দখল করে নিয়েছে।

তাই শেখ হাসিনা তার বাবা শেখ মুজিবের মতো দ্রতই আমাদের ঈমানের ওপর হামলা করেনি বা করতে পারেনি। ধীরে ধীরে করেছে। ইসলামী রাজনীতি বন্ধ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মাদরাসাগুলোতে অনৈসলামিক কালচারের চর্চা, ইসলামী ফাউন্ডেশনে নাচ গান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মুসলিম মেয়েদের পর্দা করতে না দেওয়া, বোরকা নিয়ে শেখ হাসিনার বাজে মন্তব্য, মাদ্রাসা নিয়ে জয়ের বক্তব্যসহ শত শত আওয়ামী মন্ত্রী ও নেতাদের ইসলাম বিরোধী বক্তব্য নিয়মিতভাবে তারা দিয়ে আসছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে গরুর গোশত খাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা, ইফতার মাহফিলে নিষেধাজ্ঞা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শত শত পূজা মন্ডপ বানানো, হিন্দুদের হোলি উৎসব চালু, ইফতার মাহফিলে হামলাসহ নানবিধ ইসলামবিরোধী কাজ করে যাচ্ছে আওয়ামী সরকার। সামনে আজান বন্ধ করলেও অবাক হওয়ার মতো কিছু থাকবে না।
যারা আওয়ামী লীগ করেন তারা নিজের দিকে তাকান।

আপনারা জামায়াতের বিরোধীতা করতে গিয়ে আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। যদি পরকালে বিশ্বাস রাখেন তবে আওয়ামী লীগ করা ছাড়েন। হাসিনার কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। নতুবা জাহান্নামের জ্বালানী হওয়ার প্রস্তুতি নিন।

একইসাথে যারা ইসলামের নামে জামায়াতকে দমন করার সকল চক্রান্ত করছেন, আপনারাও জেনে নিন কার সাথে লড়ছেন! ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা মূর্তি পূজারীরাই জামায়াতকে শত্রু মনে করে। খেয়াল করে দেখবেন আকাবিরে দেওবন্দসহ দেওবন্দী মাদরাসাকে মূর্তি পূজারীরা শত্রু জ্ঞান করে না। যাস্ট ভেবে দেখবেন। আপনাদের নসিহত করার দৃষ্টতা দেখাতে চাই না। আল্লাহ আপনাদের বিবেকের রুদ্ধ দ্বার খুলে দিন। হেরার আলোয় উদ্ভাসিত করে দিন।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন