শুক্রবার দুপুর। জুমার নামাজ শেষে বিরিয়ানি খাচ্ছিল শোভন। বন্ধুরা তখন বার বার ফোন দিচ্ছিল। ফোন পেয়েই বিচলিত হয়ে পড়ে সে। কোনো রকম খাওয়া শেষ করে দৌড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে সে। গুলি করছে ডাইনি হাসিনার পালিত সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ ও পুলিশ লীগ। এই অবস্থায় তো আর ঘরে থাকা যায় না।
সেদিন ছিল ১৯ জুলাই। শোভন ও তার বন্ধুরা খুবই উত্তেজিত। লড়াই করতে হবে। গত ১৬ জুলাই আবু সাঈদ ভাইসহ ৬ জন শহীদ হয়েছেন। গতকাল ১৮ জুলাই মুগ্ধ ভাইসহ প্রায় ৪০ জন ভাই শহীদ হয়েছেন। এই খুনের প্রতিশোধ নিতেই হবে।
রাগে ক্ষোভে মুখ লাল হয়ে ওঠে শোভন ও তার বন্ধুদের। হাসিনার দীর্ঘদিনের শোষণ থেকে উদ্ধার করতে হবে দেশকে। এই খুনের শাস্তি পেতেই হবে হসিনাকে। তাকে ফাঁসিতে ঝুলতেই হবে। কিন্তু হাসিনার রক্ত নেশা তো আর থামে না। ১৯ জুলাইও সমানে খুন করে যাচ্ছে সে।
শোভন ও তার বন্ধুরা শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলে নিউমার্কেট এলাকায়। নিউমার্কেট পেট্রোল পাম্পের সামনে ধাওয়া-পালটা ধাওয়া চলছে। গুলির শব্দ হচ্ছে মুহুর্মুহু। ছাত্ররা জীবন বাজি রেখে লড়ে যাচ্ছে সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ ও পুলিশ লীগের সাথে। পুলিশ গুলিতে একের পর এক ছাত্র লুটিয়ে পড়ছে জমিনে। দুইজন তাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে হসপিটালে। বাকীরা আবার রাস্তায়। ইট ছুঁড়ে ঠেকিয়ে দিচ্ছে সন্ত্রাসীদের। এমন সময় দেখা গেল রাস্তায় সিজদার মতো করে উবু হয়ে আছে একজন।
ছাত্ররা একটা কাঠের চৌকি দিয়ে কাভার দিয়ে রাস্তায় সিজদা দিয়ে থাকা ছাত্রকে উদ্ধার করতে যায়। পুলিশসহ সন্ত্রাসীরা তখন ছাত্রদের ধাওয়া খেয়ে পিছু হটে। সিজদা দিয়ে থাকা ছাত্রকেই ধরতেই সে কাত হয়ে পড়ে যায়। একটা কথাই বলে ওঠে সে, আমাকে একটু হাসপাতালে নিয়ে যান প্লিজ। শেষ! এরপরই নিথর হয়ে পড়ে ছাত্রটি। দুইজন আন্দোলনকারী ছাত্রটি কোলে নিয়ে দোড়াতে থাকে। একজন গলায় ঝুলে থাকা আইডি কার্ড নিয়ে দেখলো নাম সাইদুল ইসলাম শোভন। শেখ বোরহান উদ্দিন কলেজ।
শোভনের মা বলেছিল, বাস্তবে শোভন এতটা সাহসী ছিল না। সে সামান্য হাত কাটা গেলে অস্থির হয়ে যেত। অথচ আমাদের শোভন দেখিয়ে দিয়েছে দেশের প্রয়োজনে, খুনের বদলা নিতে, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে শাস্তি দিতে সেই ভয়কে জয় করে নিয়েছে।
শাহদাতের আগে শোভন পুলিশের গুলি উপেক্ষা করে তীব্র গতিতে এগিয়ে যায় ইট পাটকেল নিয়ে। শোভন একা ছিল না। শোভনের মতো আরো অনেকে উড়ে গিয়েছিল সন্ত্রাসীদের হটাতে। পুলিশ হটেছে কিন্তু পুলিশের গুলি ঝাঁঝরা করে দেয় শোভনের ছোট্ট বুক।
কত আর বয়স ছিল শোভনের? ১৯ কি ২০! এই ছোট্ট মানুষ ছোট্ট বুক দিয়ে ঠেকিয়ে দিয়েছে হাসিনাকে। রুখে দিয়েছে দীর্ঘ ১৬ বছর অত্যাচার চালানো ডাইনীকে। শোভন ও তার বন্ধুরা ছোট্ট বুক পেতে রক্ষা করেছে আমাদের।
গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল শোভন। পড়াশোনার জন্য জাপান যাওয়ার কথা ছিল তার। কাগজপত্রও প্রায় রেডি। কিন্তু আর যাওয়া হলো না তার। তার আগেই আমাদের রক্ষা করতে গিয়ে মালিকের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলো ওপারে।
শোভনের বন্ধুরা শোভনের পকেট থেকে মোবাইল নিয়ে কল করে তার মাকে। তার বাবা তখন ব্যবসার কাজে ছিল ইন্ডিয়ায়। মা ছুটে আসেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বন্ধুরা ওকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছার আগেই শোভন একটি লম্বা নিঃশাস নেয়। এ যেন প্রশান্তির নিঃশ্বাস। বন্ধুরা বুঝতে পারে শোভন আর বেঁচে নেই। শোভনও দেশের জন্য জীবন দিতে পেরে যেন নির্ভার, প্রশান্ত চিত্ত!!
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তার পালস পরীক্ষা করে জানান, আর নেই। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বন্ধুরা। এমন সময় হাসপাতালে পৌঁছে যান শোভনের মা। কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। তার আর্তনাদে হাসপাতাল যেন থমকে দাঁড়িয়েছে। শোভনের আম্মু শোভনকে হাসিনার গুলির সামনে যেতে নিষেধ করেন। কিন্তু শাহদাতের চেতনায় উজ্জীবিত শোভন গুলির মুখে অবলীলায় প্রাণ দেয়।
শোভনের আম্মা শাহনাজ বেগম বলেন, "পাগলের মত ছুটে গেলাম হাসপাতালে... গিয়ে দেখি ইমার্জেন্সির এক কোণায় একটা ট্রলিতে আমার শোভন পড়ে আছে, কয়েকটা ছেলে ওর পাশে দাঁড়ানো... শোভনের কাছে দৌঁড়ে গেলাম, আমার ছেলের দেহ নিথর। কত্ত ঝাঁকুনি দিলাম, ছেলে কিছু বলে না। কোনো কথা বলে না, একটু নড়েও না। আমার শোভন তখন আর নাই! আমরা তো জানতাম না আমার ছেলের দেশের প্রতি এই রকম ভালোবাসা ছিল"
তিনি আরও বলেন, "কত্ত স্বপ্ন ছিলো ছেলেটাকে নিয়ে, সব শেষ হয়ে গেলো। আমার সাজানো-গোছানো সংসারটা শেষ হয়ে গেলো! জানি না বাকি জীবনটা কিভাবে কাটবে আমাদের! সরকারের কাছে আমাদের কিছু চাওয়ার নাই। শোভন দেশের জন্য যে স্বপ্ন বুকে নিয়ে মারা গেছে- শোভন যেমন দেশ চেয়েছিল সেরকম হোক এই দেশটা। দেশের মানুষ যেন আমার সন্তানকে মনে রাখে, ওর আত্মত্যাগের কথা ভুলে না যায়"।
আমরা শোভনকে ভুলে যাবো না। যে শোভন বুক আগলে দিয়ে আমাদের রক্ষা করেছে, আমরা আমাদের বুকের মাঝে শোভনকে যত্ন করে রাখবো, ইনশাআল্লাহ।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন