২৬ নভে, ২০২৪

সবাই ভয় পেয়ে পেছনে চলে গেলে হবে নাকি?

উল্লাস চলছে, বিজয়ের উল্লাস!!

হঠাৎ গুলির শব্দ আসলো থানার দিক থেকে। দৌড়ে গেলো ইয়াসির ও তার বন্ধুরা। যাত্রাবাড়ী থানা থেকে সমানে গুলি করছে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পোষা সন্ত্রাসী পুলিশ লীগ। প্রতিরোধের ব্যবস্থা করলো ইয়াসির ও বন্ধুরা। এক পর্যায়ে পিছু হটলো পুলিশ। তারা যাত্রাবাড়ী থানার অভ্যন্তরে ঢুকে গেল। ইতোমধ্যে ৫ জন স্পট ডেড। আহত পঞ্চাশের কাছাকাছি। আহত ও নিহতদের হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলো। হাজার হাজার প্রতিবাদী ঘিরে ফেললো যাত্রাবাড়ি থানা। বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে লাগলো তারা।

সেদিন ছিল ৫ আগস্ট। ডাইনী শেখ হাসিনা পালিয়ে গেল ভারতে। দুপুর থেকেই শুরু হলো জনতার বাঁধভাঙ্গা উল্লাস। বিপ্লবীরা আল্লাহকে সিজদা দিয়ে শুকরিয়া আদায় করতো। মিষ্টি বিতরণ করতে লাগলো জনতা। এমন এক আনন্দঘন মুহূর্ত বিষাদে পরিণত করলো যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশেরা। হাসিনার পতনে জনতার এমন উল্লাস তাদের পছন্দ হয়নি। তাই তারা গুলি করে মানুষকে ছত্রভঙ্গ করে দিতে চাইলো।

নারায়ণগঞ্জের সরকারি আদমজীনগর এম ডব্লিউ কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলো ইয়াসির সরকার। তাদের বাসা শনির আখড়ায়। যাত্রাবাড়ির আন্দোলনের একজন সফল বিপ্লবী ইয়াসির। তাদের জীবন বাজি রেখে করা আন্দোলনে হাসিনাকে শেষ পর্যন্ত পালিয়ে যেতে হয়েছে। ঢাকার যেসব স্থানের মানুষ সবচেয়ে বেশি রক্ত দিয়েছে তার মধ্যে যাত্রাবাড়ী অন্যতম। খুব সম্ভবত সবচেয়ে বেশি শাহদাতের নজরানা এই যাত্রাবাড়ীতেই। বিজয়ের পরেও যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ মানুষ খুন করে।

প্রতিরোধ গড়ে তুলে ইয়াসিররা। প্রায় শ'খানেক পুলিশ আবারো গুলি করতে করতে থানা থেকে বেরিয়ে আসে। ইয়াসিররা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে পুলিশদের উদ্দেশ্যে। এক পুলিশের নির্মম গুলি এসে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয় ইয়াসিরের ছোট্ট বুক। থেমে যায় ঘাতকের বুলেট। প্রবল আক্রোশে সন্ত্রাসী পুলিশ আবারো গুলি করে। আরেকটি গুলি এসে গুড়িয়ে দেয় কিশোর ইয়াসিরের পাঁজরের হাড়। না, তারপরও খুনীদের রক্ত পিপাসা থাকে। লুটিয়ে পড়া ইয়াসিরের কোমরে আরেকটি গুলি করে তারা। ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় সারা দেশের বিপ্লবীরা যখন উল্লাস করছে তখন একের পর এক যাত্রাবাড়ীর বিপ্লবীরা শহীদ হচ্ছিলেন।

পুলিশের গুলিতে ইয়াসিরের বন্ধুরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিলো। ইয়াসিরের লাশ নিয়ে কয়েকজন মানুষ রওনা হন হাসপাতালের দিকে। কিন্তু তারা তার পরিচয় জানেন না। এমন সমন একজন বলে উঠলেন, এরে আমি চিনি, এর নাম ইয়াসির। ইয়াসিরকে বহনকারীরা ইয়াসির না শুনে শুনেছে ইয়াসিন। লাশটার নাম হয়ে পড়ে ইয়াসিন। চলে যায় ঢাকা মেডিকেলের মর্গে।

এদিকে ইয়াসিরকে ফোনে না পেয়ে ইয়াসিরের পরিবার বেশ উদ্বিগ্ন। তারা সব যায়গায় খবর নেওয়া শুরু করেছিলেন। কিন্তু কেউই খবর দিতে পারে নি। ইয়াসিরের বড় বোন ফেসবুকে ইয়াসিরের একটি ছবি পোস্ট করে জানায়, ইয়াসিরকে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকেই ইয়াসির খোঁজ করে। ঢাকা মেডিকেলের মর্গ থেকে করা লাইভ করে এক ব্যক্তি। সে লাইভে ইয়াসিরের মতো একজনকে দেখা যায়। লাইভের লিংক দেওয়া হয় ইয়াসিরের বোনের করা পোস্টের কমেন্টে।

ইয়াসিরের পরিবার দেখে বুঝতে পারে এটা তাদের ইয়সিরেরই লাশ। তার পরিবার চলে যায় মর্গে। দেখে, ইয়াসিরের নিথর দেহ। পাশে রয়েছে একটি চিরকুট। তাতে লেখা 'ইয়াসিন সরকার'। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ইয়াসিরের পরিবার। খুনী হাসিনার পতনে যাত্রাবাড়ীর সফল বিপ্লবী বীর ইয়াসিরের পরিবারের নেমে আসে ঘন দুর্যোগ।

ইয়াসিরের বোন হাফসা বলেন, "মর্গে গিয়ে ভাইকে দেখে মনে হলো, আমি কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছি। ভাইয়ের গালে স্পর্শ করে দেখলাম, একদম ঠান্ডা হয়ে আছে। হাতও একদম শক্ত। ইয়াসির বলে ডাকলাম, যদি আমার ভাই আমার ডাকে সাড়া দেয়! কিন্তু না, ভাই আমার ডাকে একটুও সাড়া দিল না। বুকের একপাশে গুলির চিহ্ন। অন্যপাশে ব্যান্ডেজ। পেছনে কোনো গুলি আছে কি না, দেখার জন্য কাত করতেই পিঠ থেকে অনবরত গল গল করে রক্ত বের হতে থাকে। বুকের দুই পাশে দুইটা, কোমরের মাঝ–বরাবর পেছনের দিক থেকে একটা—মোট তিনটা গুলি করেছে আমার ভাইকে"

ইয়াসির সরকারের বাবার একটি কাপড়ের দোকান ছিল শনির আখড়ায়। তিনি একজন ক্যান্সার রোগী। ছোট ছেলে ইয়াসিরের শোকে বাবা আর দোকানে যেতে পারেননি। দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন। বড় দুই ভাই চাকুরি করেন বিধায় ইয়াসিরই তার বাবাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেত। ৫ আগস্টের কথা উল্লেখ করে ইয়াসিরের বাবা ইউসুফ সরকার বলেন, সেদিন দিবাগত রাত একটা থেকে দেড়টার দিকে ছেলের লাশ নিয়ে বাসায় ফিরি। বিভিন্ন ভিডিওতে দেখছি, পুলিশ পাখির মতো মানুষকে গুলি করে মেরেছে।

ইয়াসিরের বড় বোন হাফসা বুশরা জানালেন, তাঁর ভাই আন্দোলন থেকে ফিরে সারাদিনের গল্প শোনাতো। নিজে কী করতেন, তা বলতো, বন্ধুরা কী করেছে তা বলতো, কত মানুষ রক্তাক্ত হয়েছে তা বলতো। কীভাবে পুলিশ ফাঁকি দিয়ে বেঁচে এসেছে তা বলতো। এত সাহস দেখানোর জন্য বোন তাকে বকাও দিতো। উত্তরে ইয়াসির বলেছিলো, 'সবাই ভয় পেয়ে পেছনে চলে গেলে হবে নাকি'?

ইয়াসির পরিবারের সদস্যদের বলেছিলেন, তিনি সরকারি চাকরি পাওয়ার জন্য আন্দোলনে যাচ্ছেন না। তিনি আন্দোলনে যাচ্ছেন ছাত্র-জনতাকে যেভাবে মারা হচ্ছে, তার প্রতিবাদ জানাতে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইয়াসিরের আন্দোলনে যাওয়াতে ভয় পেতেন তাঁর মা বিলকিস আক্তার। যেতে দিতে চাইতেন না। তাই সে মা'কে ফাঁকি দিয়েই প্রতিদিন আন্দোলনে গিয়েছিলো। মা তাকে ফোন দিলে বলতো, বাসার কাছেই আছি, দ্রুত চলে আসবো।

আগেরদিন ৪ আগস্টও ইয়াসির আন্দোলনে গিয়েছিলো। সেদিন হাতের আঙুলে ব্যথা পেয়ে বাসায় ফিরেছিলো। মা বিলকিস আক্তার নিজেই ছেলের হাতে বরফ ও মলম লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তখন তিনি ছেলেকে আর আন্দোলনে যেতে নিষেধ করেছিলেন। বিলকিস আক্তার বলেন, আমি তাকে বলেছি, আঙুলে একটু ব্যথা পেয়েই তোমার কত কষ্ট হচ্ছে। যাঁরা আন্দোলনে গিয়ে পঙ্গু হচ্ছে, তাঁদের কেমন কষ্ট হচ্ছে বলো? তুমি আর আন্দোলনে যেয়ো না। ইয়াসির বললো, আমি আন্দোলনে গিয়ে শহীদ হবো। এ কথা শুনে মা বলেছিলেন, যাঁরা শহীদ হন, তাঁরা তো চলেই যান। কিন্তু তাঁদের মা-বাবাকে সারাজীবন এই কষ্ট বুকে নিয়ে বেড়াতে হয়।

আল্লাহ তায়ালা ইয়াসিরের কথা কবুল করেছেন, আর মা তার ছোট ছেলে হারানোর ব্যথা সারাজীবন বুকে নিয়ে বেড়াবেন। আর আমরাও ভুলে যাবো না ইয়াসিরকে। পরম মমতায় জীবন দিয়ে ইয়াসির যেভাবে আমাদের উদ্ধার করেছে হাসিনার কবল থেকে আমরা সেভাবে আমার অন্তরের সবচেয়ে সুন্দর স্থানে ইয়াসিরের স্মৃতি ধারণ করে রাখবো, ইনশাআল্লাহ।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন