২০ ডিসে, ২০২৪

আমার জন্য গর্বিত হয়ো, মা !


কান্নায় বার বার গলা ধরে আসছে আনাসের। অস্থির হয়ে পড়েছে সে। কিন্তু সে তো ছোট, তার কিছুই করার নেই। আজ ৪ আগস্ট। আজকেও খুনী হাসিনা খুন করেছে ১০০-এর বেশি মানুষকে। হাজার হাজার আহত মানুষ আর লাশের সারি দেখতে দেখতে রীতিমত কান্না করছে আনাস। কতটুকু আর বয়স তার! ১৫ বা ১৬। কিন্তু এতটুকু বয়সেই তার বয়সী ছেলেরা দায়িত্ব নিয়েছে রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রকে তারা ফ্যাসিবাদ মুক্ত করবেই। জীবনের বিনিময় হলেও রক্তখেকো স্বৈরাচারী হাসিনাকে তারা শাস্তি দিবেই।

জুলাই বিপ্লব দুই ধাপে হয়। ১ম ধাপ ১৬-২১ জুলাই। এরপর আন্দোলন থমকে যায়। শুরু হয় গণগ্রেপ্তার। ঘরে ঘরে হানা দিয়ে ছাত্রদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে হাসিনা। একে একে ১৯ হাজার ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে হাসিনা। আনাস এই কঠিন পরিস্থিতি দেখছে আর রাগে ক্ষোভে ফুঁসছে। সরকারের জুলুমের ভয়ে আনাসকে আন্দোলনে যেতে বাধা দেয় তার পরিবার। মা তার ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। আন্দোলনের ২য় পর্যায় শুরু হয় ৩১ জুলাই থেকে। ৩ ও ৪ আগস্ট আবারো মানুষ খুন করতে থাকে আনাস। আনাসের আর সহ্য হয় না। ৪ তারিখে ভয়াবহ গণহত্যা তাঁর ছোট্ট মনকে ভেঙ্গে দেয়। এদিকে হাসিনা বৃদ্ধ থেকে শিশু বাচ্চা কাউকে রেহাই দিচ্ছে না। ৭১ সালে পুরো ৯ মাসের যুদ্ধে ঢাকায় যত গুলি বর্ষিত হয়নি তার চেয়ে বেশি গুলি চলে জুলাই বিপ্লবের ১ মাসে।

আনাস আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। ৫ তারিখ সকালে সে ঘুম থেকে ওঠে একটি চিঠি লিখে তার মাকে উদ্দেশ্য করে।
//মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি। আমি নিজেকে আর আটকিয়ে রাখতে পারলাম না। সরি আব্বুজান। তোমার কথা অমান্য করে বের হলাম। স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে থাকতে পারলাম না। আমাদের ভাইরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কাফনের কাপড় মাথায় বেঁধে রাজপথে নেমে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। অকাতরে নিজেদের জীবন বিসর্জন দিচ্ছে। একটি প্রতিবন্ধী কিশোর, ৭ বছরের বাচ্চা, ল্যাংড়া মানুষ যদি সংগ্রামে নামতে পারে, তাহলে আমি কেন বসে থাকব ঘরে। একদিন তো মরতে হবেই। তাই মৃত্যুর ভয় করে স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে না থেকে সংগ্রামে নেমে গুলি খেয়ে বীরের মতো মৃত্যু অধিক শ্রেষ্ঠ। যে অন্যের জন্য নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেয় সে-ই প্রকৃত মানুষ। আমি যদি বেঁচে না ফিরি, তবে কষ্ট না পেয়ে গর্বিত হয়ো। জীবনের প্রতিটি ভুলের জন্য ক্ষমা চাই।
-আনাস।//

আনাস উপলব্ধি করতে পারে তাকে তার মা বের হতে দিবে না, তাই সে চিঠি লিখে গোপনে বাসা থেকে পালিয়ে যায়। ৫ আগস্ট কর্মসূচি শাহবাগ অভিমুখে লংমার্চ। সকাল সাড়ে নয়টার মধ্যেই আনাস গেন্ডারিয়া থেকে শাহবাগ চলে আসে। হঠাত পুলিশ সায়েন্স ল্যাব থেকে গুলি ছুঁড়ে। ছাত্র জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। পর মুহূর্তেই তারা ঘুরে দাঁড়ায়। ইট পাটকেল হাতে পুলিশকে প্রতিরোধ করতে থাকে। ছাত্রজনতা চারদিক থেকে ঘিরে ধরে পুলিশকে। পুলিশের বেপরোয়া গুলিতে একের পর এক মানুষ ঢলে পড়ে যাচ্ছে। তবুও মানুষের ভয় নেই।

এদিকে নিউমার্কেট থানা থেকে আরেকদল পুলিশ চাংখার পুল হয়ে শাহবাগের দিকে এগিয়ে আসে। তড়িৎ গতিতে প্রতিরোধ গড়ে তুলে ছাত্ররা। তাদের মধ্যে একজন ছিল আমাদের আজকের গল্পের নায়ক আনাস। চাংখার পুল থেকে পুলিশকে হটিয়ে দেয় ছাত্ররা। কিন্তু পিছু হটতে থাকা পুলিশের বেপরোয়া গুলিতে ঢলে পড়তে লাগলো একের পর এক ছাত্র। এর মধ্যে আনাসও গুলিবিদ্ধ হয়। দশম শ্রেণির কিশোর ছাত্র বুকের বাঁ পাশ দিয়ে হজম করে নেয় স্বৈরাচার হাসিনার নির্মম বুলেট। আনাস মাকে বলে এসেছিল আমার জন্য গর্বিত হয়ো। মাকে সেই গর্ব করার উপলক্ষ্য এনে দিয়ে আনাস বুক দিয়ে রুখে দিয়েছে হাসিনাকে। বাঁচিয়ে দিয়েছে আমাদের মতো কোটি কোটি জনতাকে।

আনাসের পকেটে একটি পুরোনো ছোট মোবাইল ফোল ছিল। এতে সবার নম্বর ছিল। সেখান থেকে নম্বর নিয়েই মা সানজিদা খানকে ফোন করে হাসপাতালে যেতে বলেছিলেন আন্দোলনকারীদের একজন। ফোন পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন মা। তিনি ভেবেছিলেন, ছেলের শ্বাসকষ্ট আছে, সে হয়তো কাঁদানে গ্যাসের শেলে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আর বড় কোনো অঘটন ঘটলে গায়ে রাবার বুলেট লাগতে পারে। তবে হাসপাতালে গিয়ে মা দেখেন, সিঁড়ির পাশে একটি স্ট্রেচারে পড়ে আছে ছেলের রক্তাক্ত নিথর দেহ। যেই দেহে কোনো প্রাণ নেই।

সানজিদা খান বলেন, ছেলের লাশ হাসপাতাল থেকে বাইরে আনার পর বাসায় ফেরার জন্য কোনো যানবাহন পাওয়া যাচ্ছিল না। ব্যাটারিচালিত এক অটোরিকশাচালক যেতে রাজি হন। অটোরিকশায় বসে কোলে করে ছেলের লাশ বাসায় আনি। যে দেশটাকে ছেলে ভালোবাসল, সেই দেশ তো নিরাপত্তা দিতে পারল না। আমার বুক তো খালি হয়ে গেল। আল্লাহ যেন এর বিচার করেন।

অটোরিকশায় তিনি ও তাঁর স্বামী বসেন। কোলে নেন ছেলের লাশ। এভাবেই বাসায় ফেরেন তাঁরা। আন্দোলনে যাওয়ার জন্য উদ্গ্রীব ছিল ছেলে। বাবার নিষেধ থাকায় সে যেতে পারছিল না। তবে শেষ পর্যন্ত ছেলেকে আর আটকে রাখা যায়নি। ছেলে আন্দোলনে যেতে পারছিল না বলে মন খারাপ করত।

শাহারিয়ার খান আনাস গেন্ডারিয়ার আদর্শ একাডেমিতে বিজ্ঞান বিভাগে দশম শ্রেণিতে পড়তো। দুপুরে স্কুল থেকে ছেলে ফিরলে সবাই মিলে খাবার খেতেন। সানজিদা খানের কোনো মেয়ে না থাকায় আনাসই তাঁকে তাঁর দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করত। মায়ের কাছে ছেলের তেমন কোনো বায়না ছিল না। করোনা মহামারি দেখা দেওয়ার পর থেকে বাবার ব্যবসা ভালো যাচ্ছিল না। বিষয়টি বুঝত আনাস। বাসার একটি চাবি আনাসের কাছে থাকত। অন্যদিন চাবিটি সঙ্গে রাখলেও সেদিন ছেলে ঠিকই চাবিটি বাসায় রেখে গিয়েছিল।

আনাসের শাহদাতের খবর যখন বাবা মা পেয়েছিলেন ততক্ষণে আনাসের রক্তধৌত হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গিয়েছিল। ডাইনি হাসিনা পালিয়ে গিয়েছিল। সারা দেশবাসী আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়েছে। ঢাকার এক কোটি মানুষ রাস্তায় নেমে আনন্দ করছিল। কিন্তু আনাসের বাবা মা হারিয়ে ফেললেন তাদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। হাসিনা পতনের খুশিতে আনন্দ করার অবকাশ পাননি আনাসের পরিবার। তাদের ছোট্ট আনাসের রক্তেই পবিত্র হয়েছে বাংলাদেশ।

আনাস শুধু তার মা-বাবার গর্ব নয়। আনাস আমাদের গর্ব। আনাস যেভাবে বীর বিক্রমে ও ভালোবাসায় আমাদের ডাইনির হাত থেকে রক্ষা করেছে আমরাও সেই ভালোবাসা দিয়ে আনাসকে স্মরণ করবো ইনশাআল্লাহ।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন