২৩ ডিসে, ২০২৪

আল্লাহ আমাকে একটা সন্তানও দেননি। আমি এখন কীভাবে বাঁচব?


১৯ জুলাই। ঘটনাস্থল রামপুরা। ভীষণ গোলাগুলি চলছে। আবুল হোটেল থেকে রামপুরা পূর্ববাজার পর্যন্ত ছাত্র-জনতার দখলে। পুলিশ ও বিজিবি বিটিভি সেন্টারের সামনে থেকে কিছুক্ষণ পর পরই গুলি চালাচ্ছিল। গুলিতে খুলি উড়ে গেছে বেশ করেকজনের। জুমআর পর থেকেই আন্দোলনে অংশ নিয়েছে শোহান, ওলি উল্লাহ ও নূর হোসেন। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে লড়তে থাকে ক্রমাগত। বিকেল ৪ টার দিকে বিজিবির গুলি ঝাঁঝরা করে দেয় শোহানকে।

দুই বন্ধু ও আন্দোলনকারীরা শোহানকে পাশেই থাকা বেটার লাইফ হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে থাকা কর্মকর্তারা চিকিৎসা দিতে চায় নি। প্রাথমিক কিছু কাজ শেষে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেলে। সেখানে এক্স-রে করে বুকে গুলি থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়। ঢাকা মেডিকেল কর্তৃপক্ষও ভর্তি নেয়নি। তদুপরি তখন ঢাকা মেডিকেলেও সংঘর্ষ চলছিল। পুলিশ ও আওয়ামী লীগের কর্মীরা আহতদের ওপর নির্যাতন করছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে সেখান থেকে একপ্রকার পালিয়ে আসেন তাঁরা।

এরপর আরও কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ঘুরে গুলিবিদ্ধ শোহানকে ভর্তির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন পরিবারের সদস্যরা। প্রায় ১২ ঘণ্টা অ্যাম্বুলেন্সে ঘুরে ভোর সাড়ে ৪টার দিকে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয় শোহানকে। সেখানে ওই দিনই ছোট একটা অস্ত্রোপচার করা তাঁর। তবে গুলি শরীরে থেকে বের করা যায় নি।

ডাইনি শেখ হাসিনার নৃশংস নির্যাতন এখানেই শেষ হয়নি। বক্ষব্যাধি হাসপাতালে জামায়াত-শিবিরকে শোহানের সহকর্মী ওলিউল্লাহ ও নূর হোসেনকে পিটিয়েছে পুলিশ। ওলিউল্লাহ বলেন, গত ২২ জুলাই বক্ষব্যাধি হাসপাতালে শোহানকে অক্সিজেন নিতে সহযোগিতা করছিলেন। এমন সময় পুলিশ এসে ‘জামায়াত-শিবির’ বলে লাঠি দিয়ে বাড়ি দেয়। বাইরে বসে থাকা আরেক সহকর্মী নূর হোসেনকেও লাঠিপেটা করা হয়। শুধু তাই নয়, শোহানের দুই সহকর্মীকে আটক করে বনানী থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। সেখানে ৪ ঘণ্টা আটক থাকার পর বহু চেষ্টা তদবির করে মুক্তি পান তারা।

এদিকে শোহানের অবস্থা খারাপ। পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য শোহানকে ভারতে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন তাঁরা। এর জন্য পাসপোর্ট করতে গিয়ে নানা রকম বাধার মুখে পড়তে হয়। এমনকি শোহান যখন ঢাকায় বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি তখন গাজীপুরের শ্রীপুর থানায় করা নাশকতার একটি মামলায় তাকে আসামি করা হয়েছে।

২৪ জুলাই শ্রীপুর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইন ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে একটি মামলা করেন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আবদুল খালেক। সেখানে আসামি হিসেবে ৯৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। অজ্ঞাতনামা আসামি দেখানো হয় ১৫০ থেকে ২০০ জনকে। মামলার এজাহারে ১৮ নম্বর আসামি হিসেবে নাম রয়েছে শাহ সেকেন্দারের ছেলে শোহানের। মামলার অভিযোগে বলা হয়, ওই দিন (২৪ জুলাই) সকাল ৬টার দিকে শ্রীপুরের আলতাফ হোসেন মহিলা কলেজ মাঠে জড়ো হয়ে ককটেল বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির করছিলেন আসামিরা। একদিকে চিকিৎসার অপর্যাপ্ততা অন্যদিকে মামলার আসামী হওয়ায় শোহান ও তার পরিবারের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়।

অতঃপর ৫ আগস্ট বিপ্লব হয়। বিপ্লবের ধাক্কায় নতুনভাবে চিকিৎসা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হয়। ইনফেকশনের শিকার হয় শোহান। বক্ষব্যাধি হাসপাতাল থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)। কিন্তু দীর্ঘদিন চিকিৎসায় অবহেলা হওয়াতে শোহানের অবস্থা দিন দিন খারাপ হয়ে পড়ে। অবশেষে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ৩৯ দিন পর ২৭ আগস্ট সিএমএইচ চিকিৎসাধীন অবস্থায় শাহদাতবরণ করে সে।

খুব অল্প বয়সেই সংসারের হাল ধরেছিলেন শোহান শাহ। মা-বাবা, স্ত্রী ও স্কুলছাত্র ছোট ভাইয়ের সব খরচের জোগান আসত একজনের বেতন থেকেই। পরিবারের সবার ভরসার শোহান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। বুকে বুলেট নিয়ে ৩৯ দিন কষ্ট করেছে সে। এখন পরিবারের সদস্যরা পড়েছেন অকুল পাথারে।

শোহান শাহের (২৯) বাড়ি মাগুরার শ্রীপুর উপজেলা সদরে আলতাফ হোসেন মহিলা কলেজ রোড এলাকায়। অর্থ সাশ্রয়ের জন্য স্ত্রীকে বাড়িতে মা-বাবার কাছে রেখে ঢাকায় মেসে থেকে চাকরি করছিলেন। গ্রামের বাড়িতে নতুন ঘর নির্মাণ করা হচ্ছিল। যেখানে স্ত্রী শম্পা বেগমের সঙ্গে সুখের সংসার পাততে চেয়েছিলেন শোহান শাহ। তবে তাঁদের সেই স্বপ্ন অপূরণ থেকে গেল।

শ্রীপুরে শোহানদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর স্ত্রী শম্পা বেগমের বিলাপ কিছুতেই থামছে না। পরিবারের অন্য সদস্যরা তাঁকে নানাভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি বারবার বলছেন, শোহানকে ছাড়া এখন আমি কীভাবে বাঁচবো? শম্পা বেগম বলেন, তাঁদের বিয়ে হয়েছিল ২০১৭ সালের ১৯ নভেম্বর। এরপর মধ্যে তিন বছর দুজন একসঙ্গে ঢাকায় সংসার পেতেছিলেন। বাকি সময় স্ত্রীকে গ্রামে পরিবারের সঙ্গে রেখে ঢাকায় চাকরি করেছেন শোহান। শম্পা বেগম বলেন, ‘আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবার। অর্থসংকটের কারণে ও একা ঢাকায় থাকত। অর্থের কারণে দুজন একসঙ্গেও থাকতে পারিনি। গত এক বছর বাড়িতে একটা নতুন ঘর দিচ্ছিল। সে আমাকে বলেছিল, “শম্পা, আমি আর তুমি এই ঘরে থাকব।”’

গত মঙ্গলবার ঢাকায় সিএমএইচে স্বামীর সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল শম্পার। তখন শোহান শম্পাকে বলেছিলেন, ‘তুমি কেঁদো না। আমার কিছুই হবে না।’ তবে শোহান আর ফেরেননি। অস্ত্রোপচার করে শরীর থেকে বুলেট বের করা গেলেও রক্ত বন্ধ করা যায়নি। ১৮ ব্যাগ রক্ত দিয়েও বাঁচানো যায়নি শোহানকে। সংসারে অভাব থাকলেও ভালোবাসার কমতি ছিল না উল্লেখ করে শম্পা বলেন, ‘স্বামী ছাড়া কেউ ছিল না আমার। সে সব সময় সব ধরনের পরিস্থিতিতে আমার পাশে থেকেছে। সে বলত, “চিন্তা করো না, আমি তোমার পাশে আছি।” আল্লাহ আমাকে একটা সন্তানও দেননি। আমি এখন কীভাবে বাঁচব?’

মাগুরার শ্রীপুর ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে প্রায় ১০ বছর আগে সংসারের হাল ধরতে চাকরিতে যান শোহান। সবশেষ ঢাকার রামপুরা এলাকায় একটি পোশাক কারখানায় টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি। তাঁর বাবা শাহ সেকেন্দার এক দশকের বেশি সময় আগে নিজের ব্যবসা গুটিয়ে বেকার হয়ে পড়েন। তাঁর একমাত্র ছোট ভাই অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে।

বাবা শাহ সেকেন্দার বলেন, ‘আমার ছেলে ছোটবেলা থেকেই স্মার্ট, কর্মঠ আর দায়িত্বশীল। ছোটবেলা থেকেই ইনকাম করে। বিশেষ করে বিয়ের পর একদিনও বসে থাকেনি। চাকরি না থাকলে বাড়িতে এসে রাজমিস্ত্রির কাজও করেছে। আমার পকেটখরচও সে দিত। যেদিন মারা গেল সেদিন সকালেও বিকাশে আমাকে এক হাজার টাকা পাঠিয়ে বলল, এই টাকাটা তুলে চলে আসেন।’

ছেলে হারানোর শোকে বিলাপ করছিলেন শোহানের মা সুফিয়া বেগমও। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে আমার মনের কথা বুঝত। কোনো কথা লুকালে ও বুঝে ফেলত। টাকা পাঠিয়ে বলত, “মা তুমি আঁচলে গুঁজে রেখো না, যা লাগে কিনে খাও আমি আছি তো। আমার ইনকাম না খেয়ে তোমাদের মরতে দেব না।”’ সুফিয়া বেগম বলেন, ‘এখন এই কথা আমাকে কে বলবে? সবাই আছে শুধু আমার ছেলে নেই।’

বাবা শাহ সেকেন্দার বলেন, ‘আমার ধারণা, ওর গুলি লেগেছে, এটা জেনেই এলাকার লোকজন ও পুলিশ ষড়যন্ত্র করে মামলায় তাঁকে আসামি করেছে। আমার ছেলেকে গুলি করা থেকে শুরু করে চিকিৎসায় বাধা দেওয়া, মিথ্যা মামলা দেওয়া সব অপরাধের ন্যায়বিচার চাই আমি।’

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন