ইনতিশারের বয়স আর কত হবে? ২০ বা ২১। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলো সে। আন্দোলন করার বয়স তার কি হয়েছে? কোটা বিরোধী আন্দোলনের শুরুতে জানতোই না সে দেশে কী হচ্ছে বা হবে। কিন্তু যেদিন আবু সাঈদ শহীদ হয়েছে সেদিন তার মাথা ঘুরে যায়। তার উপলব্ধি হলো, আবু সাঈদ ভাই তো আমাদের জন্য জীবন দিয়েছে। আমাদের ভবিষ্যত জীবনের বিশাল ফাঁড়া কোটাপ্রথা দূর করার জন্য আবূ সাঈদ ভাই জীবন দিয়েছে।
এই উপলব্ধি থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্রসমাজের ডাকে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো ময়মনসিংহের ত্রিশালের ইনতিশার। আন্দোলনের শুরু থেকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তিনি। প্রতিদিন রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল শ্লোগানে মাতিয়ে রেখেছিলো সারা মাস। বেশ কয়েকদিন পুলিশের সাথে লড়াইও করতে হয়েছে। হালকা আহতও হয়েছিল বেশ কয়েকবার।
কিন্তু কোনো ভয়ই তাকে আন্দোলন থেকে দূরে রাখতে পারে নি। আন্দোলনের ২য় পর্যায়ে আবারো রাস্তায় নামে ইনতিশার। ৩ আগস্ট থেকে সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। এত রক্ত নিশ্চয়ই বৃথা যাবে না। এবার নিশ্চয়ই হাসিনার পতন হবে। গ্রাফিতি আঁকিয়ে তারা পুরো এলাকায় আন্দোলন চাঙ্গা রেখেছে।
৪ আগস্ট সারাদেশে শতাধিক মানুষকে খুন করে ডাইনি হাসিনা। ইনতিশাররা আরো ক্ষেপে যায়। চোখে মুখে ফুটে ওঠে প্রতিশোধের আগুন। এর মধ্যে ঢাকা থেকে ঘোষণা এলো লংমার্চ ৬ তারিখ না হয়ে ৫ আগস্ট হবে। প্রস্তুতি নেয় ইনতিশাররা। ৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ অংশগ্রহণের জন্য মা-বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যান ইনতিশার। ভোর থেকেই শুরু হয় তাদের পদযাত্রা। যত সময় বাড়ে তত মিছিলের দৈর্ঘ্য বাড়ে। হাজার হাজার মানুষ ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
পথিমধ্যে গাজীপুরের মাওনা পৌঁছালে তাদের বাধা দেয় পুলিশ বিজিবি লীগ। গুলি করতে থাকে পুলিশ। অকুতোভয় ইনতিশারই ইট হাতে প্রথমে প্রতিরোধ করে পুলিশকে। স্বৈরাচার হাসিনার পুলিশ ও বিজিবি গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেয় ইনতিশারের ছোট বুক। বিকেল ৪টা ১১ মিনিট থেকে ৪টা ২৫ মিনিটের মধ্যে ইনতিশার গুলিবিদ্ধ হন বলে ধারণা পরিবারের। কারণ, ৪টা ১১ মিনিটের আগে নিজের ফেসবুকে সরব ছিলেন ইনতিশার। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর মাওনার একটি হাসপাতালে নিলে সেখান থেকে চিকিৎসকেরা ময়মনসিংহ মেডিকেলে নেওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু ময়মনসিংহে নেওয়ার পথে সঙ্গে থাকা লোকজন ইনতিশারের নড়াচড়া না পেয়ে তাঁকে ভালুকা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
ততক্ষণে জানা গেছে ডাইনি হাসিনা পালিয়ে ভারত চলে গেছে। ছাত্র আন্দোলনের বিজয়বার্তায় যখন সারা দেশ আনন্দে উদ্বেলিত ঠিক সেই সময় ইনতিশারের বাড়িতে খবর আসে সে আর নেই। এ খবরে তার মা-বাবা পাগলপ্রায়। ছেলের কথা মনে হলেই বার বার মূর্ছা যান মা। মা নাজমুন্নাহার বলেন, আমার ছেলে বলে গেল 'মা, যাচ্ছি, দেশ স্বাধীন করে ফিরে আসবো। দেশ স্বাধীন হলো কিন্ত, সে আর ফিরল না। আমি এখন কাকে আদর করে বাবা বলে ডাকবো!!
ইনতিশারের বাড়ি ত্রিশাল উপজেলার বইলর ইউনিয়নের উজান বইলর গ্রামে। সে ওই গ্রামের আ হ ম এনামুল হক লিটনের বড় ছেলে। সে ময়মনসিংহ নগরের রুমডো পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সিভিল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। পাশাপাশি ত্রিশালের কাঁঠাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ২০২৩ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ইনতিশারের মা-বাবা দাবী করেন, আমাদের আদরের সন্তান চিরদিনের জন্য সব মায়া-মমতা ফেলে দেশের জন্য যুদ্ধ করে না ফেরার দেশে চলে গেছে, তাকে যেন জাতীয় বীরের মর্যাদা দেওয়া হয়।
ইনতিশারের ছোট ভাই বাশিরুল হক মাহির বলেন, আমার ভাই আমার বন্ধু ছিল, কোটা সংস্কার আন্দোলনে আমার ভাই নিহত হয়েছেন। আমার ভাই যেন আবু সাঈদের মতো জাতীয় বীরের মর্যাদা পান। চাচা অধ্যক্ষ মাওলানা নাজমুল হক বলেন, আমাদের পরিবারের সবার বড় ইনতিশার কোটা আন্দোলনে লং মার্চ টু ঢাকায় যাওয়ার পথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়। বর্তমান সরকারের কাছে আমাদের পরিবারের আবেদন তাকে যেন জাতীয় বীরের মর্যাদা দেওয়া হয়। বইলর ধানীখোলা সড়ককে ইনতিশারের নামে নামকরণ করার দাবি জানান তিনি।
বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কারের দাবিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে শহিদ ইনতিশারের মা-বাবাকে সান্ত্বনা ও তার আত্মার মাগফিরাত কামনায় কবর জিয়ারত করতে ছুটে যান ত্রিশাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকতা জুয়েল আহমেদ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্ররা ইনতিশারকে জাতীয় বীরের মর্যাদা দেওয়ার জন্য বর্তমান সরকারেরকাছে জোর দাবি জানান।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক রবিউস সানি বলেন, ইনতিশার আন্দোলনের প্রথম থেকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। মার্চ টু ঢাকায় যাওয়ার পথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে নিহত হন তিনি। আমরা এ হত্যার বিচার চাই। জাতীয় বীরের নামের তালিকায় ইনতিশার যেন স্বর্ণ অক্ষরে লেখা থাকে এ দাবি জানাই।
ছেলের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বাবা এনামুল হক বলেন, 'সে আগেও আন্দোলনে গেছে, সে সময় বাধা দিইনি। আমাদের মনে ভয়-আতঙ্ক ছিল, তবে আমাদের মৌন সম্মতি ছিল।' তিনি আরও বলেন, 'তিন ছেলের মধ্যে বড় ইনতিশার। আমাদের পরিবারের সবাই উচ্চশিক্ষিত। আমাদেরও স্বপ্ন ছিল পড়ালেখা শেষ করে সে প্রতিষ্ঠিত হবে। সামাজিক ও একজন ভালো মানুষ হবে, এই প্রত্যাশা ছিল। জাতির বৃহত্তর প্রয়োজনে সন্তান মৃত্যুবরণ করেছে। আমার মনে দুঃখ নেই। সবাই তাঁদের শহীদ বলছে। আল্লাহ তাআলা যেন শহীদের মর্যাদা দেন, বাবা হিসেবে এটিই চাওয়া।'
ইনতিশারের বাবা বলেন, ভালুকা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনা হয়েছে এই খবর পেয়ে সেখানে যাই। সেখানে ছেলের লাশ পাই। একটি গুলি বুকের বাঁ পাশে লেগে ডান দিকে বেরিয়ে যায়। পরে সেখান থেকে আমরা লাশ নিয়ে আসি।’ তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে তাঁর ফেসবুকে শেষ পোস্ট দিয়েছিল, লাল বৃত্তের মধ্যে স্বাধীনতা লেখা। কিন্তু আমার ছেলে সেই স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেনি, স্বাদ ভোগ করতে পারেনি।’
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন