৬ জানু, ২০২৫

দেশের খবর নিয়ে তৃপ্তির ঘুম দেন ফরিদ শেখ

ছাত্রজীবনে ছাত্রদলের সাথে যুক্ত ছিল সে। তাই মামলার ভারে জর্জরিত ছিল ফরিদ। পালিয়ে থাকতে হয় তাকে। কিন্তু তাই বলে তো জীবন থেমে থাকে না। ফরিদকে বিয়ে দেয় তারর পরিবার। মায়ের বড় আদরের ছিলেন ফরিদ। ৫ মেয়ের পর ৬ষ্ঠ সন্তান হিসেবে ফরিদের মা ফরিদকে পায়। ব্যবসা করার জন্য বিভিন্ন মানুষ থেকে ১১ লক্ষ টাকা ধার করে ফরিদ।

জীবনটা বড় কঠিন ফরিদের। সরকার ও আওয়ামী লীগের ক্রমাগত নির্যাতনে ব্যবসাটা ঠিকভাবে করতে পারে না মুন্সিগঞ্জের ফরিদ শেখ। ব্যবসায় লস করতে থাকে। একদিকে পরিবার চালানোর চাপ অন্যদিকে পাওনাদারদের তাড়া। জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে উঠে শেখ ফরিদের।

মুন্সিগঞ্জ ছেড়ে চলে আসেন যাত্রাবাড়ীতে। কাজ নেন ফলের আড়তে। মানবেতর জীবনযাপন করে টাকা জমিয়ে কিছু ঋণ শোধ করেন কিছু দিয়ে পরিবারের খরচ চালান। এভাবেই চলছিল তাঁর জীবন। প্রায় দুই লক্ষ টাকা শোধও করেছনে তিনি।

শুরু হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আন্দোলন। ফরিদ শেখ প্রথমে ছাত্রদের সহায়তা করতেন। পরে একেবারেই সম্পৃক্ত হয়ে যান আন্দোলনের সাথে। ৪ আগস্ট ছিল খুবই উত্তপ্ত একটি দিন। যাত্রাবাড়ীতে সেদিন ২০ জনের বেশি মানুষ শাহদাতবরণ করে। বেলা ১১ টায় ফরিদ যখন ফলের আড়তের কাজ শেষ করে তখন ইতোমধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়।

ফরিদ তার বন্ধুদের নিয়ে যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলনে অংশ নেয়। তারা শ্লোগানে শ্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুলে। যাত্রাবাড়ির পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনী সমানে গুলি করতে থাকে। এমনি একটি গুলি ফরিদের পেটে এসে লাগে। নাড়ি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় ফরিদের। বন্ধুরা ফরিদকে নিয়ে প্রথমে যাত্রাবাড়ীতে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে তার চিকিৎসার অপর্যাপ্ততা থাকায় নিয়ে যায় মুগদা মেডিকেল হাসপাতালে।

এর পরদিন অর্থাৎ ৫ আগস্ট পালিয়ে যায় ডাইনী হাসিনা। দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু জ্ঞান ফেরে না ফরিদ শেখের। ৬ আগস্ট অল্প সময়ের জন্য জ্ঞান ফেরে তার। চোখ খুলেই জিজ্ঞাসা করে, দেশের কী খবর? তাকে স্বজনেরা জানায়, দেশ স্বাধীন! হাসিনা পালাইছে। যেন তৃপ্তি নেমে আসে ফরিদের চোখে। চোখ বন্ধ করে ফরিদ। এই চোখ আর খুলে নি।

৬ আগস্টই শাহদাতবরণ করে ফরিদ শেখ।

প্রতিদিন বাড়িতে মা-বাবার কাছে অন্তত দুবার ফোন দিয়ে কথা বলতেন মুন্সিগঞ্জের মো. ফরিদ শেখ। তাঁর বয়স এখন তিরিশের ঘরে। একসময় ছাত্রদলের রাজনীতি করা ফরিদ ৪ আগস্ট মাকে চারবার ফোন দিয়েছেন। প্রতিবার ফোনে মাকে দেশের অবস্থা জানিয়ে সতর্ক করেছেন। বাবা ও ছোট ভাইকে বাড়ি থেকে বাইরে যেতে নিষেধও করেন। কিন্তু ওই দিন নিজে আন্দোলনে গিয়ে শাহদাতবরণ করেন।

তাঁর মা আলেয়া বেগম বলেন, ‘আমাগো সাবধানে থাকতে কইয়া নিজে আন্দোলনে গিয়ে জীবন দিল। পোলাডার পেটে গুল্লি কইরা নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়া দিল। দুই দিন হুঁশ ছাড়া বাইচ্চা আছিল। ৬ আগস্ট কিছু না কইয়াই মইরা গেল।’

ফরিদ মুন্সিগঞ্জের সদর উপজেলার সুখবাসপুর এলাকার সুলতান শেখের ছেলে। সাত ভাই-বোনের মধ্যে ফরিদ ভাইদের মধ্যে বড় ছিলেন। আলেয়া বেগম বলেন, ‘ফরিদ ৫ মেয়ের পর হইছে। আমার খুব আদরের পোলা। পোলাডাও আমারে ছাড়া কিছু বুঝত না। দেশের লাইগা আন্দোলনে গেল। পুলিশ ও আওয়ামী লীগের মাইনষেরা মাইরা ফালাইল।’

ফরিদের বাবা সুলতান শেখ বলেন, ‘আমাগো খুব অভাব-অনটনের সংসার। ফরিদ ব্যবসা করার লাইগা ১১ লাখ টাকা ধার করছিল। ব্যবসায় মাইর খাইয়া যাত্রাবাড়ী ওর চাচাতো ভাইগো দোকানে এক বছর আগে কাজ লইছিল। দুই লাখ টাকা ধার শোধ করছিল। এখন আমাগো সংসারই তো ঠিকমতো চলব না। ধারের টাকা কেমনে শোধ করমু?’

ঘটনার দিনের বর্ণনা দিয়ে সুলতান শেখ বলেন, ‘ফরিদ ৪ আগস্ট সকালে আড়তে কাজ করছিল। দুপুর ১২টার দিকে ওর ফোন থেকে একটি ফোন আসে। ফোন রিসিভ করতেই অচেনা একজন বলল, ফরিদের পেটে গুলি লাগছে। ওরে হাসপাতালে নিতাছে। আমরা যেন তাড়াতাড়ি যাই। ওই দিন ঢাকার অবস্থা অনেক খারাপ আছিল। রোগী আর লাশে ভরা। কয়েকটা হাসপাতালে নিয়াও চিকিৎসা দিতে পারি নাই। শেষে মুগদা হাসপাতালে জ্ঞানহীন অবস্থায় ভর্তি করাই। পরদিন একবার চোখ খুইল্লা তাকাইয়া জিগাইল, দেশের কী অবস্থা। ওই দিনই বেলা ১১টার দিকে মারা যায়।’

ফরিদদের বাড়িতে গেলে জরাজীর্ণ একটি টিনের ঘর দেখিয়ে জানানো হয়, ওই ঘরেই থাকতেন ফরিদ। ফরিদের বিছানায় বসে স্বজনদের সঙ্গে ফরিদের স্মৃতিচারণা করছিলেন তাঁর বাবা-মা। পাশেই বসে ছিলেন ফরিদের চাচাতো ভাই রবিউল ইসলাম। তাঁদের আড়তে কাজ করতেন ফরিদ।

রবিউল ইসলাম বলেন, জুলাই মাসে দেশে যখন আন্দোলন শুরু হলো, তখন থেকে ফরিদ আন্দোলনে যেতেন। ভোর থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত আড়তে ব্যস্ত থাকতেন। কাজ শেষ করে তাঁদের না জানিয়ে আন্দোলনে চলে যেতেন। বিষয়টি জানতে পেরে ওকে নিষেধ করতেন। যখন বলতেন, চুপ করে শুনতেন। পরদিন আবার আন্দোলনে চলে যেতেন।

ফরিদ শেখের আড়াই বছরের একটি মেয়ে আছে। স্ত্রী ও সন্তানের কথা জিজ্ঞেস করতেই স্বজনেরা জানালেন, চার বছর আগে ফরিদকে বিয়ে করান। মৃত্যুর পর পাওনাদাররা বাড়িতে আসতে পারেন ভেবে তাঁর স্ত্রী ইতি আক্তারকে বাবার বাড়িতে নিয়ে গেছেন স্বজনেরা। ফরিদের চল্লিশার দিন তাঁর আসার কথা আছে। ফরিদের বাবা সুলতান শেখ বলেন, ‘যারা আমার ছেলেকে হত্যা করেছে, পুরো সংসারটি এলোমেলো করে দিয়েছে, আমি সেই হত্যাকারীদের বিচার চাই।’

ফরিদের প্রতিবেশী ও জেলা ছাত্রদলের দপ্তর সম্পাদক ইমতিয়াজ নিপু বলেন, ‘ফরিদ সব সময় স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে যেকোনো কর্মসূচিতে আমাদের সঙ্গে অংশ নিতেন। বিয়ের পর কাজের জন্য আমাদের সঙ্গে কর্মসূচি করতে পারেননি। তবে ঢাকায় যেকোনো কর্মসূচিতে অংশ নিতেন।’ তিনি বলেন, ফরিদ দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন। এখন তাঁর পরিবার সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পরিবারটির পাশে দাঁড়াতে সবার প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।

ছোট্ট আড়াই বছরের শিশু কন্যা ফাতেমা আক্তারকে এতিম করে চলে গেলেন ফরিদ। তার মৃত্যুর পর স্ত্রী ইতি আক্তারের আড়াই বছরের একমাত্র মেয়েকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন পিতার অভাব অনটনের সংসারে। বাবা ঢাকায় আছে বললে আদরের অবুঝ ফুটফুটে শিশু কন্যা ফাতেমা আশায় থাকে বাবা সেখান থেকে ‘মজা’ নিয়ে আসবে। পরক্ষণেই হারিয়ে যায় আবার খেলার জগতে। বাবাকে বাবা বলে ডাকতে পারলো না ফাতেমা। যে দিন জানবে পিতার মৃত্যুর ঘটনা সেদিন তার সামনে চলে আসবে এক ভয়ংকর ইতিহাস। ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করবে হাসিনার ফ্যাসিষ্ট দোসরদের।

ফরিদের মৃত্যুর তিন মাস পরেও মা অপেক্ষায় থাকেন ছেলের ফোনের জন্য। আদরের প্রথম পুত্র ফরিদের শোকে কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে গেছে তার।

ফরিদ স্থানীয় বছিরননেছা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করে। সংসারে অভাবের কারণে পড়াশুনা বেশি করতে পারেনি। আমি দীর্ঘদিন হিমাগারে কাজ করায় শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। কোন কাজ করতে পারিনা। সংসারে হাল ধরতে ফরিদ দেড় বছর আগে ঋণ নিয়ে ফোনের দোকান দেয়। ব্যবসায় মার খেয়ে তা বন্ধ হয়ে যায়। অভাবের সংসারে সুখ আনতে ঢাকার যাত্রাবাড়িতে চাচাত ভাই নুরুল আমীনের কলার আড়তে কাজ শুরু করে।

ফরিদের পিতা জানান, জেলা প্রশাসন থেকে ২০ হাজার এবং জামায়াতের পক্ষ থেকে দুই লক্ষ টাকা সহায়তা হিসেবে দেয়া হয়েছে। আগামী দিনের অজানা এক চিন্তায় দিশেহারা ইতি আক্তার আরো বলেন, বিশ হাজার টাকা শুধু পেয়েছি। জামায়াতে ইসলামী থেকে শ্বশুর যে দুই লক্ষ টাকা পেয়েছেন সেখান থেকে কিছুই আমি পাইনি।

এ সময়ে তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। অশ্রুভেজা চোখে ইতি বলতে থাকেন, ‘স্বামীর সংসারও করতে পারলাম না, শ্বশুর বাড়ীতেও এখন স্থান হচ্ছে না। জীবনের বড় সম্পদ স্বামীকে হারিয়েছি।’ এতিম সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে প্রশাসনসহ সকলের সহযোগিতা কামনা করেছেন ইতি।

আমরা আমাদের বীর শহীদ, যারা নিজের জীবন দিয়ে আমাদেরকে খুনী হাসিনার হাত থেকে রক্ষা করেছে তাদেরকে ভুলে যেতে দেব না। তাদেরকে তাদের সন্তানকে কোলে পিঠে করে রাখবো ইনশাআল্লাহ।

পুনশ্চঃ এই খবর জানার পর জামায়াত পুনরায় ফরিদ শেখের স্ত্রী ইতি'র কাছে এক লক্ষ টাকার সহায়তা হস্তান্তর করে।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন