১১ জানু, ২০২৫

আনন্দ মিছিল পরিণত হয় বিষাদে


৪ আগস্ট দেড়শতাধিক মানুষকে মেরে ফেলে পুলিশ। ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে ছাত্ররা। আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। ৬ তারিখের ঢাকামুখী লংমার্চ একদিন এগিয়ে ৫ আগস্ট করার ঘোষণা দেওয়া হয়। স্বৈরাচারী হাসিনাকে যে করেই হোক তাড়াতে হবে এমন আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন মনিরুজ্জামান। মিছিলে থাকা অবস্থায় জানতে পারেন, সরকারের পতন হয়েছে। তখন মনিরুজ্জামান তাঁর বন্ধু মো. আলম কাজীকে নিয়ে প্রবেশ করেছিলেন গণভবনে। উৎসুক জনতার সঙ্গে বিজয়ের উল্লাসে মেতে উঠেছিলেন তাঁরাও। কিন্তু এ আনন্দ নিয়ে ঘরে ফেরা হয়নি তাঁর।

৫ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে মোটরসাইকেল নিয়ে বের হয়েছিল মনিরুজ্জামান। সঙ্গে ছিলেন তার বন্ধু আলম। হাসিনা পালিয়েছে শুনে তারাও অন্যদের দেখাদেখি গণভবনে যান। দুজনই লাল-সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে বিজয় উল্লাস করে সন্ধ্যার দিকে গণভবন থেকে বের হয়ে আসেন। পরে তারা পুলিশ সদর দপ্তর সংলগ্ন ফুলবাড়িয়া এলাকায় গিয়ে একটি মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় করেন।

তারা যখন মসজিদে ছিলেন তখনই গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। পুলিশ সদর দপ্তরে তখনো কিছু গণহত্যাকারী পুলিশ লুকিয়ে ছিল। জনতা তাদের ঘেরাও করলে পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলি করতে করতে বেরিয়ে আসে। শুরু হয় জনতা ও সন্ত্রাসী পুলিশের সংঘর্ষ। মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসে মনিরুজ্জামান ও তার বন্ধু আলম। গুলির মুখে পড়ে যায় দুই বন্ধু। সন্ত্রাসী পুলিশের একটি গুলি এসে লাগে মুনিরুজ্জামানের গায়ে। লুটিয়ে পড়েন তিনি। আহত হন বন্ধু আলম। এরপরও থেমে থাকে নি পুলিশ। লুটিয়ে পড়া মনিরের ওপর আবারো গুলি করেছে পুলিশ। পরে গুরুতর অবস্থায় দুজনকে স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। ওই দিন রাতেই মনিরুজ্জামান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

নিহত মনিরুজ্জামান মোল্লার (২৬) বাড়ি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার ইশিবপুর ইউনিয়নের শাখারপাড় মোল্লাবাড়ি। তাঁর বাবার নাম মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম মোল্লা। মনিরুজ্জামান রাজধানী ঢাকার সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজে পড়ালেখা করতেন। পাশাপাশি একটি জুতার কোম্পানিতে কাজ করতেন। পরদিন ৬ আগস্ট সন্ধ্যায় স্বজনেরা জানতে পারেন মনিরুজ্জামানের লাশ ঢাকা মেডিকেলের মর্গে রয়েছে। ওই দিন রাতে মনিরুজ্জামানের লাশ অ্যাম্বুলেন্সে করে রাজৈর উপজেলার ইশিবপুর ইউনিয়নের শাখারপাড় মোল্লাবাড়িতে আনা হয়। পরদিন সকালে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর দাফন করা হয়।

রাজৈর উপজেলাধীন ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের শানেরপাড় বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার ভেতরে শাখারপাড় মোল্লাবাড়ি গ্রাম। মনিরুজ্জামানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙাচোরা একটি টিনশেড ঘর। এই ঘরেই মা-বাবা আর স্ত্রীকে নিয়ে বাস করতেন মনিরুজ্জামান। মনিরুজ্জামানের এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মানতে পারছে না তাঁর স্বজনেরা। তাঁর স্ত্রী সামিরা ইসলাম সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্বামীই ছিল তাঁর একমাত্র ভরসা। সামিরা বলেন, ‘আমার সন্তান এখনো পৃথিবীর আলো দেখে নাই, তার আগেই ও বাবাকে হারাল। এখন আমার সন্তান কাকে বাবা বলে ডাকবে? স্বামী ছাড়া এই দুনিয়াতে আমার আপন কেউ নাই। হায় আল্লাহ, আমার স্বামীর কী দোষ ছিল? আমি কি আমার স্বামী হত্যাকারীদের বিচার পাব?’

মনিরুজ্জামানের কথা জিজ্ঞাসা করতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁর মা মনোয়ারা বেগম। ছেলের কথা ভেবে এখনো বারবার মূর্ছা যান তিনি। বাবা মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম মোল্লাও বাকরুদ্ধ। কাঁদতে কাঁদতে মনোয়ারা বেগম বললেন, ‘আমার পোলাডারে গুলি কইরা মারছে, আমি কার কাছে এই কথা কমু? কার কাছে বিচার দিমু। আমার ছেলেডা ছোট হইলেও অনেক দায়িত্ব নিত। পোলাডা আমার মা-বাবা ছাড়াও বোনগো খেয়াল রাখত। আমার নয়নের মণি ছিল। আল্লারে তুমি আমার পোলাডারে ফিরাইয়া দাও।’

তিন ভাই, দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট মনিরুজ্জামান। বড় দুই ভাই অন্য শহরে আলাদা থাকেন। ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর পর বড় দুই বোনও বাবার বাড়িতে এসেছেন। বোন নুসরাত জাহান বলেন, ‘আমার ভাই কোনো রাজনীতির সঙ্গে ছিল না। সাধারণ মানুষের মতো বিজয় মিছিলে গেছিল। সেখান থেকে আর ফিরা আইলো না। আমার ভাইডাকে চারটি গুলি কইরা মারছে। বুকে, পিঠে, হাতে ও পায়ে চারটি গুলি করলে কেউ কি বাঁইচা থাকে।’

মনিরুজ্জামানের বন্ধু আলম কাজীর বাড়ি মাদারীপুর শহরে। ওই দিনের বর্ণনায় আলম বলেন, ‘আমরা গণভবনের ভেতরে ঢুকে পড়ি। পতাকা হাতে নিয়ে ছবি তুলি। কত স্মৃতি আমাদের। ফেরার পথে ফুলবাড়িয়ায় যখন পুলিশের সঙ্গে লোকজনের সংঘর্ষ হচ্ছিল, আমরা তখন মাঝখানে পড়ে যাই। চারদিক থেকে তখন গুলির আওয়াজ। কিছুক্ষণ পরে দুজন দুদিকে সরে পড়ি। এরপর কিছু লোক আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে শুনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মনির (মনিরুজ্জামান) আর বেঁচে আর নেই। সেই দিনের কথা এখনো চোখে ভাসছে।’

মনিরুজ্জামান মোল্লা লেখাপড়ার পাশাপাশি চাকুরি করতেন। তার আয় দিয়েই চলতো সংসারের খরচ। দেশের জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করলেন তিনি। শহিদ হলেন। কিন্তু তার সংসারের চাকা গেলো অচল হয়ে। মনিরের মৃত্যুতে আর্থিক দুরাবস্থায় পড়লেন তার বাবা, মা ও স্ত্রী। তিন ভাই, দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট মনিরুজ্জামান। বড় দুই ভাই অন্য শহরে আলাদা থাকেন। ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর পর বড় দুই বোনও বাবার বাড়িতে এসেছেন। বোন নুসরাত জাহান বলেন,‘আমার ভাইকে চারটি গুলি কইরা মারছে। বুকে, পিঠে, হাতে ও পায়ে চারটি গুলি করলে কেউ কি বাঁইচা থাকে?’

এদিকে মনিরুজ্জামান পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। তার পিতা বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। আয় রোজগার করতে পারেন না। এখন সংসারের খরচ চালানো নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে পরিবারটি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন