১৪ মার্চ, ২০২৫

বাংলাদেশে ফিড মিল তৈরির ইতিহাস

 

তখন মিরপুর এতটা প্রসিদ্ধ ছিল না। গবির মানুষদের বসবাস সেখানে। জানালা দিয়ে তাকালেই দেখা যায় সারি সারি বস্তির ঘর।

মোটা পলিথিন দিয়ে ছাউনি দেওয়া বস্তির একটি ঘর। সেই ঘরের কর্ত্রী সন্তানসম্ভবা। ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে বস্তির মানুষদের দিনলিপি দেখা যায়। সেই দিনলিপি দেখে বস্তির মানুষদের জন্য কিছু সহায়তা করার চিন্তা আসে দালানে থাকা মানুষটার।

একদিন বস্তির সেই সন্তানসম্ভবা মহিলা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিল্ডিং-এ থাকা মানুষটা তার স্ত্রীকে নিয়ে ছুটে যান সেই মহিলার কাছে। গাড়ি ডেকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন।

বস্তির মহিলাটির ভীষণ অপুষ্টি। হিমোগ্লোবিন ছিল খুবই কম। দালানের মানুষটি ডাক্তার হাসপাতাল ইত্যাদির সাথে জড়িত মানুষ ছিলেন। বস্তির মহিলাটির সমস্যা সমাধানে পুরো হাসপাতাল তৎপর হয়ে গেলো।

কিন্তু সর্বনাশ তো আগেই হয়ে আছে। দীর্ঘদিন অপুষ্টিতে থাকা মহিলাটির বাচ্চাটিকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। ছোট্ট বাচ্চাটি জন্ম নেয়ার সময়ই ইন্তেকাল করে। মহিলাটি এই যাত্রায় বেঁচে যায়। কিন্তু বাঁচার সংগ্রামটা ছিল বড়ই কষ্টসাধ্য।

দালানের মানুষটার কপালে ভাঁজ পড়ে। কিছু একটা করতে হবে এই সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের জন্য। পারিবারিক পুষ্টি নিশ্চিত করতেই হবে। অপুষ্টির জন্য মানুষ মারা যাবে এই দেশে, এটা তো কোনোভাবেই হওয়া উচিত না।

দিন রাত চিন্তা করে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেন মহিলাদের জন্য। মহিলারা ঘরের ছোট্ট কোণায় গড়ে তুলবে মুরগির খামার। (৪/৬/৮ টি মুরগির একটি খাঁচা + ৪/৬/৮ টি ডিম পাড়া মুরগি + মুরগির খাবার + ঔষধ) এই মিলে একটা প্যাকেজ। মহিলাদের ঘরের সদস্য অনুসারে প্যাকেজ দেওয়া হবে। তারা কিস্তিতে প্যাকেজের মূল্য পরিশোধ করবে। যারা কিস্তি তুলতে আসবে তারাই ছোট খামার তদারক করবে। মুরগির ঔষধ ও খাবার দিয়ে যাবে।

দালানের মানুষটা এর মাধ্যমে তিনটা উদ্দেশ্য হাসিল করতে চেয়েছেন। এক. দেশের উৎপাদন বাড়ানো। দুই. মহিলাদের মাধ্যমে বাড়তি পারিবারিক আয়। তিন. মূল উদ্দেশ্য পারিবারিক পুষ্টি নিশ্চিত।

পরিকল্পনা অনেক বড়। কিন্তু সামর্থ সীমিত। তাই নিজের শিক্ষক স্ত্রীকেই কাজে লাগালেন। তাঁর স্ত্রী নিজে প্রশিক্ষণ নিলেন, কীভাবে খাঁচায় মুরগী পালতে হয়? অসুবিধা কী কী হয়? সেগুলো কীভাবে ওভারকাম করতে হয়?

স্বামী স্ত্রী মিলে প্রতিষ্ঠানটিকে দাঁড় করাতে থাকলেন। নিজের বারান্দায় মুরগির খামার গড়ে তুললেন। মহিলাদের ডেকে ডেকে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলেন তারা। সফলতা পেতে শুরু করলেন। বহু মহিলা এই প্যাকেজ কার্যক্রমে যুক্ত হলেন। এরপর ওনারা দেখলেন ওনাদের প্রচুর ফিড দরকার।

এটি আশির দশকের ঘটনা। তখন পোল্ট্রি শিল্প বাংলাদেশে বিকশিত হয়নি। তাই ফিডের ব্যবস্থাও ছিল না। বিদেশ থেকেই আসতো কিছু। বহু মানুষ মুরগি চাষ শুরু করায় মুরগির খাদ্যের সংকট দেখা দিলো। দালানের মানুষটা ফিড তৈরি করার পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। ফিড মিল তৈরি করে ফেললেন।

শুধু তাই নয়, শহর থেকে এই কার্যক্রম গ্রামে ছড়িয়ে দিলেন। সেখানে দেখা গেলো মানুষের পুকুরও আছে। কার্যক্রমে মাছ যুক্ত হলো। ধীরে ধীরে মুরগির বাচ্চা, মাছের পোনা, গরুর খাবার সবকিছুই তৈরি করতে লাগলেন।

যেই সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, সুযোগ পেলে সবসময় পরামর্শ দিতেন সরকার যেন "একটি পরিবার একটি খামার" প্রকল্প গ্রহণ করেন। বিশেষ করে ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে তিনি এটি ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করতে থাকেন।

দালানের সেই মানুষটির ফিড কারখানা ছিল গাজীপুরে। তিনি নানানভাবে সরকারকে উদ্বুদ্ধ করেন। সমবায় মন্ত্রনালয় অবশেষে তাদের পরিকল্পনায় বিষয়টি গ্রহণ করে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালে গাজীপুরের শ্রীপুরে "একটি পরিবার একটি খামার" প্রকল্পের পাইলটিং শুরু হয়। ততক্ষণে সরকার চেইঞ্জ হয়ে যায়।

কে ছিল সেই মানুষ? জানতে চান? বাংলাদেশের স্বৈরাচার জালিম হাসিনা এই অসাধারণ মানুষটাকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেছে। তিনি আমাদের নেতা শহীদ মীর কাসেম আলী রহ.। আর তাঁর সেই প্রতিষ্ঠানের নাম এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রাস্ট (AIT)। ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ফিড তৈরির পাইয়োনিয়ার।

কী দারুণ মানুষ ছিলেন তিনি, জানি আর অবাক হই!!

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন