২৫ মার্চ, ২০২৫

সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবনা ০৬ : সংবিধানের মূলনীতি কী হওয়া উচিত!!



বাংলাদেশ মুসলিমদের দেশ। এদেশ পরিচালনার জন্য গঠিত সংবিধান অবশ্যই মুসলিমদের চেতনার আলোকেই হতে হবে। সংবিধানের মূলনীতি যা হওয়া উচিত।
১. আল্লাহর স্বার্বভৌমত্ব
২. আদল ও ইনসাফ
৩. শুরাভিত্তিক শাসন (গণতন্ত্র)
৪. মানবতা
৫. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা

আমরা গতকাল ১ নং ও ২ নং মূলনীতি নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা ৩ নং অর্থাৎ শুরাভিত্তিক শাসন নিয়ে আলোচনা করবো। ইনশাআল্লাহ। শুরাভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা অনেকটা গণতন্ত্রের অনুরূপ।

রাষ্ট্রের তৃতীয় মূলনীতি হলো পরামর্শ এবং তাদের পারস্পরিক সম্মতিক্রমে রাষ্ট্রপ্রধান নিযুক্ত হতে হবে। রাষ্ট্রপ্রধানকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা পরিচালনাও করতে হবে পরামর্শের ভিত্তিতে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘‘আর মুসলমানদের কাজকর্ম [সম্পন্ন হয়] পারস্পরিক পরামর্শক্রমে।’’[সূরা শুরাঃ ৩৮] ‘‘হে নবী! কাজ কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করো।’’[সূরা আলে ইমরানঃ ১৫৯]

হযরত আলী রা. বলেন, আমি রাসূল সা.-কে জিজ্ঞাসা করি, আপনার পর আমাদের সামনে যদি এমন কোনে বিষয় উপস্থিত হয়, যে সম্পর্কে কুরআনে কোনো নির্দেশ না থাকে এবং আপনার কাছ থেকেও সে ব্যাপারে আমরা কিছু না শুনে থাকি, তখন আমরা কি করবো? তিনি বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে দ্বীনের জ্ঞানসম্পন্ন এবং আবেদ ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ করো এবং কোনো ব্যক্তি বিশেষের রায় অনুযায়ী ফায়সালা করবে না।’’ হযরত উমর রা. বলেন, ‘‘মুসলমানদের পরামর্শ ছাড়া যে ব্যক্তি তার নিজের বা অন্য কারো নেতৃত্বের [ইমারাত] প্রতি আহবান জানায়, তাকে হত্যা না করা তোমাদের জন্য বৈধ নয়।’’[ কানযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস নং-২৫৭৭।

হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর এ উক্তির তাৎপর্য এই যে, ইসলামী রাষ্ট্রে কোনো ব্যক্তির জোর পূর্বক চেপে বসার চেষ্টা করা এক মারাত্মক অপরাধ, তা বরদাস্ত করা উম্মতের উচিত নয়।] অপর এক বর্ণনায় হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর এ উক্তি বর্ণিত আছে, ‘‘পরামর্শ ব্যতীত কোনো খেলাফত নেই।’’[২৪. কানযুল উম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস নং-২৩৫৪।]

হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেন, ‘যদিও আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পরামর্শের কোনো প্রয়োজন নেই, তবুও আল্লাহ তাআলা আমাকে পরামর্শের নির্দেশ দিয়েছেন, এতে বহু রহমত ও বরকত রয়েছে। যারা পরামর্শ করে কাজ করবে, তারা কখনো উত্তম দিকনির্দেশনা থেকে বঞ্চিত থাকবে না। আর যারা পরামর্শ করে কাজ করবে না, তারা কখনো ভ্রান্তি থেকে নিষ্কৃতি পাবে না।’ (বায়হাকি)

আল্লাহর নবী (সা.) তাঁর জীবনে শুরা বা পরামর্শের নীতি গ্রহণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.)-এর চেয়ে নিজ সঙ্গী-সাথিদের সঙ্গে অধিক পরামর্শকারী আমি আর কাউকে দেখিনি।’ (ফাতহুল করীম ফী সিয়ামাতিন নাবিয়্যিল আমিন : পৃষ্ঠা ২৪)

মহানবী (সা.)-এর পর খলিফারা পরামর্শের ভিত্তিতে খেলাফত পরিচালনা করেছেন এবং দেশের সংকটকালে জ্ঞানী, বিচক্ষণ, দূরদর্শী ও ফকিহদের সঙ্গে পরামর্শ বৈঠক করতেন। হজরত আবু বকর (রা.) তাঁর খেলাফতকালে আনসার ও মুহাজির সাহাবিদের নিয়ে পরামর্শ করতেন। এসব বৈঠকে হজরত ওমর (রা.), ওসমান (রা.), আলী (রা.), আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.), মুয়াজ ইবন জাবাল (রা.) প্রমুখ সাহাবিরা উপস্থিত থাকতেন।

হজরত ওমর (রা.)-এর সময় রাষ্ট্রের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রথমে মজলিসে শুরায় উপস্থাপিত হতো। এখানে চুলচেরা বিশ্লেষণের পর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হতো। হজরত ওমর (রা.) বলেন, ‘পরামর্শ ছাড়া খেলাফত ব্যবস্থা চলতে পারে না।’ রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলোতে ওই সব লোকের সঙ্গে পরামর্শ করবে, যারা আল্লাহকে ভয় করে।’ (মুসতাদরাকে হাকেম)

ইবনে উমর রা. বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, তিন ব্যক্তির নামাজ কবুল হবে না। যে কোন গোত্র বা জাতির ইমাম হয়েছে অথচ তারা তাকে পছন্দ করে না, যে নামাজ পড়তে আসে দিবারে। আর দিবার হল- নামাজের উত্তম সময়ের পরের সময়কে এবং যে কোন স্বাধীন নারীকে দাসীতে পরিণত করে। (আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ)।

ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, তিন ব্যক্তির নামাজ তাদের মাথার উপর এক বিঘতও ওঠে না অর্থাৎ কখনই কবুল হয় না। ক. যে ব্যক্তি কোন গোত্র বা জাতির ইমাম হয় কিন্তু তারা তাকে পছন্দ করে না, খ. সেই নারী যে রাত্রি যাপন করেছে অথচ তার স্বামী সঙ্গত কারণে তার ওপর নাখোশ এবং গ. সেই দুই ভাই যারা পরস্পরে বিচ্ছিন্ন। (ইবনে মাজাহ)।

উপরিউক্ত হাদীসগুলো থেকে একথা স্পষ্ট কোন ব্যক্তির ইমামতির জন্য অনুসারী বা জনগনের ভোট বা সমর্থন জরুরী। অধিকাংশ জনগনের সমর্থন না থাকলে তিনি ইমামতি তথা নেতা হওয়ার যোগ্যতা হারান।

ইসলামে পরামর্শের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। এমনকি আল্লাহতায়ালা মানুষকে পৃথিবীতে প্রেরণ করার আগে ফেরেশতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে তাদের মতামত জানতে চেয়েছিলেন। এর মাধ্যমে মূলত আল্লাহতায়ালা মানবজাতিকে পরামর্শের গুরুত্ব বুঝিয়েছেন।

ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই সব কাজ সম্পাদিত হতো পরামর্শের ভিত্তিতে। ইসলাম বরাবরই পরস্পরের পরামর্শকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখে আসছে। আমাদের রাসূল সা: নিজের সিদ্ধান্ত কখনোই চাপিয়ে দিতেন না। সাহাবাদের মধ্যে তিনি যাদের গুরুত্বপূর্ণ ও যোগ্য মনে করতেন তাদের সাথে আলোচনা ও পরামর্শ করতেন। আযান কীরূপ হবে এটা নিয়ে তিনি পরামর্শ করেছিলেন, বদর যুদ্ধের গ্রেপ্তারকৃতদের সাথে কী আচরণ করা হবে এই নিয়েও তিনি আলোচনা করেছিলেন। এভাবে সব বিষয়ে তিনি সাহাবাদের সাথে আলোচনা করতেন।

খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খননের বিষয়টা পরামর্শের মাধ্যমে উঠে এসেছে এবং বেশিরভাগ সাহাবা এতে রায় দিয়েছেন। বদর যুদ্ধের গ্রেপ্তারকৃতদের ব্যাপারে দুটো প্রস্তাব এসেছিলো। আল্লাহর রাসূল সা: চেয়েছিলেন তাদের থেকে মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত করে দিতে। ঊমার রা: চেয়েছিলেন তাদের হত্যা করতে। সাহাবারা আল্লাহর রাসূলের মতামতকে বেশি ভোট দিয়েছেন তাই তাঁর সিদ্ধান্তই কার্যকর হয়েছে।

ওহুদ যুদ্ধ মদিনার ভেতরে নাকি বাইরে গিয়ে করা হবে এই সিদ্ধান্তও এসেছে পরামর্শ ও অধিকাংশের মতামতের ভিত্তিতে। এই সিদ্ধান্ত একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। মদিনার ভেতরে কিংবা বাইরে যেখান থেকেই যুদ্ধ করা হোক এর সাথে ইসলামের মূলনীতির কোনো বিরোধ নেই। কিন্তু যখন এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করলো আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই, তখন সে মুনাফিক উপাধি পেয়েছে। কারণ আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই সামষ্টিক সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এভাবে আল্লাহর রাসূল সা. ও খুলাফায়ে রাশেদার যুগে গণতান্ত্রিকভাবে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।

বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতিতে গণতন্ত্র বা শুরাভিত্তিক শাসন থাকার অর্থ হলো,

১. বাংলাদেশের যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে কারো একক সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে না। বরং সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিদের পরামর্শের ভিত্তিতে হতে হবে।
২. বাংলাদেশের নেতৃত্ব নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ থাকবে। জনগণই নিজেদের নেতা নির্বাচন করবে।
৩. কেউ একক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চাইলে সেটা সংবিধান পরিপন্থী হবে।
৪. সাংবিধানিকভাবে স্বৈরাচারের উত্থান রহিত হবে।
৫. বিচার ও আইনের উর্ধ্বে কেউ থাকবে না।

 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন